২০ সেপ্টেম্বর ২০২২, দৈনিক যুগান্তর
সিনেট নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ধারায় মহামান্য আচার্য চার বছরের জন্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ দিয়েছেন। আমরা অভিনন্দন জানাই উপাচার্য মহোদয়কে। তিনি কয়েক মাস ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। এর আগে প্রথম চার বছর নির্বাচনের পথ ধরেই উপাচার্য হয়েছিলেন অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম। পরে মহামান্য আচার্য তার মেয়াদ আরও চার বছর বৃদ্ধি করেন। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, এভাবে দ্বিতীয় মেয়াদ তৈরি হলে নানা জটিলতা দেখা দিতে থাকে। উপাচার্যরাও কেমন যেন একটু বেপরোয়া হয়ে উঠতে থাকেন। নানা অন্যায়, দুর্নীতির কথা সামনে চলে আসে। আর এসবের কারণে উত্তপ্ত হতে থাকে ক্যাম্পাস। এমন প্রেক্ষাপট অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের সময়েও তৈরি হয়েছিল। কোভিড-১৯ তাকে কিছুটা রক্ষা করেছে। করোনার কারণে আন্দোলন দানা বাঁধতে পারেনি; কিন্তু দেশের প্রথম নারী উপাচার্যের বিদায় যতটা উজ্জ্বল হতে পারত, তেমন হয়নি; একে নীরব প্রস্থানই বলা যেতে পারে।
অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলেও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন না। জাবিতে যারা শিক্ষক এবং ছাত্ররাজনীতি করেন, তাদের কাছে এ বিষয়টি খুব গুরুত্ব পায়। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ করা হয়েছিল। আন্দোলনের মুখে তিনি পদত্যাগ করেন। পরবর্তী অধ্যায়গুলোর হালহকিকত পর্যালোচনা করে এখন আন্দোলনকারীদের কেউ কেউ স্বীকার করেন, অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করাটা তাদের সঠিক ছিল না। তার সততা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেননি। যেটুকু সময় পেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতির জন্য আন্তরিক চেষ্টা করেছেন তিনি। শিক্ষক রাজনীতির কারণে অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে চলে যেতে হয়েছে। যাদের উপাচার্য হওয়ার ইচ্ছা ছিল, তিনি যেন তাদের বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে কোনো প্রশাসন যা করতে পারেনি, তেমন দুটো গুরুত্বপূর্ণ কাজ তিনি করেছিলেন। আন্দোলন-বিক্ষুব্ধ সময়ের মধ্যেও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রকে বড় আঙ্গিক দিয়েছিলেন। এছাড়া সেশনজট কমানোতেও তার চেষ্টা ছিল। নিয়োগের ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব করেছেন, এমন অভিযোগ কেউ করতে পারেননি। পরিচ্ছন্ন ক্যাম্পাস তৈরিতে তার ঐকান্তিকতা ছিল। অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের সময়কাল তুলনা করে হয়তো আন্দোলনকারী নেতাদের কারও কারও এ মোহভঙ্গ।
এমন বাস্তবতা সামনে রেখে আমি মনে করি, অধ্যাপক নূরুল আলম একটি সুন্দর সময় উপহার দিতে পারবেন। কারণ তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র ছিলেন। শিক্ষকতাও করেছেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। গণতান্ত্রিক পথেই তিনি উপাচার্য হয়েছেন। একজন সৎ ও ভালো মানুষ হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পরিচিতি রয়েছে। এর আগে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ছিলেন তিনি; তখন উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামকে নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তাকে নিয়ে কারও কোনো প্রশ্ন ছিল না। এসব কারণে আমরা মনে করি, উপাচার্য হিসাবে তার সময়কালকে উজ্জ্বল করার জন্য যথেষ্ট পুঁজি আছে তার। চাইলে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে তিনি উজ্জ্বল অবস্থান নিশ্চিত করতে পারবেন। আবার অনালোকিত নীরব প্রস্থানের তালিকায়ও চলে যেতে পারেন তিনি।
বেশ কয়েক মাস আগে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। মঞ্চে আমার পাশে যে ভদ্রলোক বসেছিলেন, পরিচয় দিলেন তিনি বাংলাদেশ পুলিশের একজন বড় কর্মকর্তা। বেশ সজ্জন সদালাপী মানুষ মনে হলো তাকে। তিনি একটি রহস্য জানতে চাইলেন। বললেন, আপনাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এত আন্দোলন হয় কেন? আমিও মজা করে বললাম, আপনাদেরই তো সবচেয়ে বেশি জানার কথা! অতঃপর আমার বিবেচনা মতো বললাম, ‘এর দুটো কারণ থাকতে পারে। একটি মুক্তচিন্তার অঞ্চল বলে এক ধারার শিক্ষার্থী-শিক্ষক অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। আরেক পক্ষ রাজনৈতিক কারণে প্রতিপক্ষ তৈরি করেন। এরা নিজ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও গোষ্ঠীস্বার্থ সিদ্ধির জন্যও আন্দোলনের নামে অরাজকতা তৈরি করেন।’
আমরা মনে করি, অধ্যাপক নূরুল আলম কাছে থেকে এসব পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাই নীতিনির্ধারণের কাজটি তিনি অনেকটা সহজে করতে পারবেন। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান বাস্তবতায় এগিয়ে যাওয়ার পথ ততটা নিষ্কণ্টক নয়। এখানে উপাচার্যদের প্রশাসন নিয়ে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া সহজ নয়। তিনি শিক্ষক রাজনীতির বলয়ের একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর নেতৃত্বে আছেন। এ গোষ্ঠীর সদস্যরা মনে করেন, তাদের সমর্থনের কারণেই তিনি উপাচার্য হতে পেরেছেন। অন্যান্য গোষ্ঠীর কোনো কোনো নেতাও দাবি করতে পারেন, অধ্যাপক নূরুল আলমের উপাচার্য হওয়ার পেছনে তাদের অবদানও কম নয়। অবশ্য এমন বাস্তবতায় সৌভাগ্যের সম্ভাবনাও থাকে। তার বলয়বৃত্তে যারা থাকবেন, তারা যদি কালিমামুক্ত থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণ চান, তবে সৎ পরামর্শ ও সহযোগিতা দেবেন তাকে। এর সঙ্গে যুক্ত হবে অধ্যাপক নূরুল আলমের ব্যক্তিগত সততা ও প্রশাসনিক দক্ষতা। এমনটি হলে এ বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে জনমনে একটি নতুন ধারণা তৈরি হবে। আমরা এমন পরিবেশেরই স্বপ্ন দেখি। কিন্তু আকাঙ্ক্ষার অপর পিঠটি খুব একটা সুখপ্রদ নয়। আমাদের আশঙ্কা-উপাচার্য মহোদয়ের সামনে নানা চ্যালেঞ্জ আসবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মাঝেমধ্যে ছাত্রলীগের নেতানেত্রীদের সুপথে আসার পরামর্শ দেন; হাতে বই তুলে নিতে বলেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ যদি এসব সদুপদেশ মানে, ক্যাম্পাস ও হলে সতীর্থ শিক্ষার্থীদের প্রভু না হয়ে বন্ধু হতে পারে, টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজির প্রচার-অপপ্রচার থেকে নিজেদের মুক্ত রেখে উপাচার্য মহোদয়কে চাপমুক্ত রাখতে পারে, তাহলে উপাচার্যের পক্ষে ইতিবাচক নীতিনির্ধারণ করা সহজ হবে। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ নেতাদের সহযোগিতার প্রয়োজন পড়বে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে অফিসার ও কর্মচারী সমিতি এবং ইউনিয়নগুলো অবশ্যই পেশাগত যৌক্তিক দাবিদাওয়া নিয়ে প্রশাসনের মুখোমুখি হবে। প্রশাসনেরও উচিত হবে ন্যায়সংগত দাবি সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করা। এক্ষেত্রে সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়, যখন দেখা যায় নিয়োগ-পদোন্নতিতে ন্যায়ানুগ ধারা ক্ষুণ্ন হচ্ছে; দলীয় দৃষ্টিতে পক্ষপাত হচ্ছে। দুর্ভাগ্য আমাদের, আজকাল অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নিয়োগ বাণিজ্য’ কথাটাও প্রচলিত হয়ে গেছে। এসব জায়গায় প্রশাসন যদি ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে না পারে এবং পেশাজীবী সংগঠনগুলো যার যার দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি মানতে গিয়ে অযথা প্রশাসনকে অস্থির করে তুলতে চায়, তবে উপাচার্যের যৌক্তিক পথে হাঁটা কঠিন হয়ে পড়বে। আশা করব, নতুন প্রশাসনের সময়কালে সব পক্ষই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে বিবেচনায় রাখবে।
নিজ রাজনৈতিক গ্রুপ এবং সহযোগী গ্রুপের শিক্ষকদের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে একজন উপাচার্যের সংকট বেশি হয়। আমার সহকর্মীরা ক্ষুব্ধ হলেও বলব, শিক্ষক রাজনীতি এখন নানা চাওয়া-পাওয়াকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। উপাচার্যদেরও নিজ বলয়ের শিক্ষকদের পরামর্শ এড়িয়ে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ কম। সংকটটি এখান থেকেই তৈরি হয়। ছোট-বড় বিভিন্ন প্রশাসনিক পদের জন্য দলীয় শিক্ষকদের আকাঙ্ক্ষা থাকে। তাই দলের বাইরের সবাই অপাঙ্ক্তেয় হয়ে যান। বিশেষ করে ক্ষোভ বড় হয় শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে। দলীয় চাপের কারণে অনেক মেধাবী প্রার্থী শিক্ষক হওয়ার স্বপ্নপূরণ করতে পারেন না। আবার অনেক উপাচার্য ও তার ঘনিষ্ঠজনরা শিক্ষক নিয়োগের জন্য তদবির পছন্দ করেন। আরও অনেক কিছুই নাকি যুক্ত হয় নিয়োগের ক্ষেত্রে। এসব চর্চা যারা করতে পারেন না, তারা মেধায় এগিয়ে থাকলেও নিয়োগে অযোগ্য হয়ে পড়েন। এসব এখন সব বিশ্ববিদ্যালয়েই ওপেন সিক্রেট।
আমরা প্রত্যাশা করি, নতুন উপাচার্য মহোদয় তার সৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য দলীয় গণ্ডিতে আবদ্ধ না থেকে সবার সৎ পরামর্শগুলোকে আমলে নেবেন। তার দলীয় রাজনীতির পরামর্শক যারা, তারা যদি উপাচার্যের সাফল্য চান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মঙ্গল কামনা করেন, তাহলে নিজেদের বাইরেও নির্ভরযোগ্য শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য দরজা খোলা রাখবেন। আমরা বিশ্বাস করি, কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ না থাকলে বড় কোনো কল্যাণ সাধিত হয় না।
বিশ্ববিদ্যালয়কে যারা ভালোবাসেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব উচ্চতায় নিতে চান, তারা প্রত্যাশা করেন নবনিযুক্ত উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলমের সময়কালে পেছনের জরা ঝেড়ে ফেলে ঘুরে দাঁড়াবে প্রশাসন। ব্যক্তি অধ্যাপক নূরুল আলমের সততা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুবিদিত। আশা করি, তার চারপাশে থাকা শিক্ষক-কর্মকর্তারাও সততার সঙ্গে পথ দেখাবেন তাকে-সহযোগিতা করবেন। এমনটি হলে আমি বিশ্বাস করি, শিক্ষার্থীদের বড় অংশ, অফিসার, কর্মচারী ও শিক্ষকদের আনুকূল্য ও সহযোগিতা তিনি পাবেন। আর এ আক্রার দিনে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তা অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়