২৫ আগস্ট ২০২০, দৈনিক যুগান্তর
আমি ইতিহাসের ছাত্র বলেই বারবার ইতিহাস থেকে পাঠ নিতে চাই। আনন্দ পেতে চাই, আশাবাদী হতে চাই। আবার ভুল থেকে শিক্ষা নিতে চাই। ক্লাসে আজকাল যখন পড়াই- বৃত্ত এঁকে সভ্যতার উত্থান, বিকাশ, পতন আর নবউত্থান দেখাতে গিয়ে মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। শিক্ষার্থীদের চোখের দিকে তাকিয়ে কতটা আনন্দ ওদের ছুঁয়ে গেল তা বোঝার চেষ্টা করি। আমি ওদের বলি, দেখ পনেরো-বিশ বছর আগেও তেমন আত্মবিশ্বাস ছিল না আমার। মনটা ম্রিয়মাণ থাকত। কোনো আশার কথা শোনাতে পারতাম না।
বলতাম, এই দ্যাখ সভ্যতার উত্থান, বিকাশ আর পতনের বৃত্ত। বৃত্তের নিচে ইংরেজি ‘আর’ লিখে বলতাম সভ্যতার উত্থান অর্থাৎ ‘রাইজ’ হচ্ছে। তারপর বৃত্তের বাঁ-দিকে ঊর্ধ্বমুখী তীর এঁকে বলতাম, দ্যাখ চলমান বৃত্ত সভ্যতার বিকাশ দেখাচ্ছে। তীর বৃত্তের মাথায় এলে বলতাম সভ্যতা এর সর্বোচ্চে পৌঁছে গেছে। যেহেতু ঘূর্ণায়মান বৃত্ত, তাই তীর এবার নিুমুখী। অর্থাৎ পতন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এটিই নিয়তি। তীর এসে নেমেছে নিচে। অর্থাৎ চূড়ান্ত পতন ঘটেছে।
তখন বলতাম, বাংলার ইতিহাসে হাজার বছর ধরে এ বৃত্তেরই ঘূর্ণন দেখেছি আমরা। বাঙালির সভ্যতা দীর্ঘকাল ধরে বিকাশমান ছিল। সমৃদ্ধির চূড়ান্তে পৌঁছেছিল। এরপর অবধারিতভাবে এর পতন ঘটেছে। তখনকার বাস্তবতায় এমন কোনো আশাবাদ দেখাতে পারিনি যে আবার আমাদের সভ্যতার নবউত্থান ঘটবে। আমাদের ভঙ্গুর সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা আশাবাদ জাগাতে পারেনি।
কিন্তু গত এক দশকে অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছিল যেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনেকটা একক শ্রম, আত্মবিশ্বাস ও নিষ্ঠায় দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরে দাঁড়াতে থাকে। শিল্প অর্থনীতিও গতি পায়। অবকাঠামোগত উন্নতিও চোখে পড়ার মতো। একটি আনন্দময় সম্ভাবনার কথা ভেবে ক্লাসের হোয়াইট বোর্ডে আবার বৃত্ত আঁকি। দেখাই সভ্যতার অমোঘ নিয়মেই পতন থেকে আবার নবউত্থান ঘটছে।
তীরটি আবার বৃত্তের বাঁয়ে চলে আসছে। এখন ঊর্ধ্বমুখী যাত্রা শুরু করবে। দেখতাম শিক্ষার্থীদের চোখ চক চক করছে। ওদের প্রশ্নের জবাবে বলতাম, কতটা দ্রুত আমরা উন্নতির চূড়ান্তে পৌঁছব তা নির্ভর করছে এ প্রজন্মের তোমাদের ওপর। নেতৃত্বে আসবে তোমরা। যদি তোমরা দুর্নীতি আর সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ গড়তে পার আর রাজনীতির অঙ্গন কলুষমুক্ত রাখতে পার, তবে দেখবে উন্নতির সূচক-তীর দ্রুত উপরের দিকে উঠবে।
আর এখানেই যদি ব্যর্থ হও, তবে সম্ভাবনা জাগানো তীর ঘুরে যেতে পারে নিচের দিকে। নির্বাপিত হতে পারে সব সম্ভাবনার আলো। চারপাশের বাস্তবতা দেখে কিন্তু হঠাৎ জেগে ওঠা আশার আলো আবার নিবুনিবু হয়ে যাচ্ছে।
মনে পড়ছে মধ্যযুগে ভারতের সুলতান মোহাম্মদ বিন তুঘলকের কথা। তার বিভিন্ন নীতি ব্যর্থ হওয়ার কারণে এসব পদক্ষেপকে তুঘলকি কাণ্ড বলে উপহাস করা হয়। আসলে কি নীতিনির্ধারণে তার পাগলামি ছিল? বরঞ্চ তিনি চিন্তার ক্ষেত্রে সময়ের চেয়ে অনেকটা এগিয়ে ছিলেন। তবে তা ধরে রাখার জন্য যে প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল তা তিনি গ্রহণ করতে ব্যর্থ হন।
আমাদেরও দুশ্চিন্তা হয় দেশের অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে ঠিকই কিন্তু বর্তমান সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে যে বিশৃঙ্খলা চলছে তা অব্যাহত থাকলে উন্নয়নের ফসল আমরা ধরে রাখতে পারব কি না। আমাদের রাজনীতি এখন দুর্নীতিতে জরাগ্রস্ত। দুর্নীতিবাজরা যে অর্থসম্পদ প্রতিদিন গ্রাস করছে ও পাচার করছে এর খেসারত জনগণকে কীভাবে দিতে হয় এ এক ভয়ংকর প্রশ্ন।
এখন চলমান সংকটগুলোর বাড়বাড়ন্ত দেখলে মনে হয় না এমন এগিয়ে চলা একটি দেশে সরকার কার্যকর আছে। সর্বক্ষেত্রে ঘুষ-দুর্নীতির এত বাড়বাড়ন্ত যে সন্দেহ হয় এসব নিয়ন্ত্রণের লাগাম বোধহয় এখন আর সরকারের হাতে নেই। যখন দুর্নীতির শেকল উচ্চপর্যায় পর্যন্ত চলে যায় তখন আর কারও ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা যায় না। তখন চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ে।
দু-একজন শাহেদ-সাবরিনা ধরা পড়লে বা লোক দেখানো অভিযান পরিচালিত হলেই যে নিশ্চিন্ত হওয়া যাচ্ছে তেমন নয়। সমস্ত অন্যায়ের পেছনে এখন রাজনৈতিক প্রশ্রয়ের কথাই উঠে আসে সবার আগে। ক্ষমতার রাজনৈতিক অঙ্গন যখন নীতিভ্রষ্ট হয়, তখন কারও ওপরই নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা যায় না। প্রতারক সাহেদকে নিয়েই তো কত প্রশ্ন উঠল। কিন্তু এসব প্রশ্নের উত্তর কি সরকারের কাছে রয়েছে?
একজন চিহ্নিত প্রতারক-দুর্নীতিবাজ গোয়েন্দাদের নজরদারিতে থাকল না। বলা যায় মন্ত্রী-এমপিসহ ক্ষমতাবানদের পক্ষপুটে চলে যেতে পারল। তাহলে তো বলা যেতেই পারে, অনেককে হাতের মুঠোয় রাখার বিশেষ ক্ষমতা তার আছে।
এমন প্রতারকের লাইসেন্স তামাদি হওয়া হাসপাতালের সঙ্গেই সরকারের মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর কোটি টাকার চুক্তি করে তাকে যোগ্যতার সার্টিফিকেট দেয়! আবার যথানিয়মে সেখানেই প্রতারণা চলতে থাকে। এমন অবস্থা বিরাজ করলে কি সরকারের অস্তিত্ব বোঝা যায়?
চুরির কারণে জোয়ারের এক ধাক্কায়ই বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। রাস্তা গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। লাখ লাখ দুঃখী মানুষের সম্পদ, জীবন ও জীবিকা বিপন্ন হচ্ছে। এসবের প্রতিবিধান তো সরকারেরই করার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে কি এর প্রতিফলন আছে বা কখনও ছিল?
ক্ষতিগ্রস্ত হলে কিছু রিলিফ তুলে দিলেই তো দায়িত্ব পালন হয় না। আবারও বাঁধ মেরামত, সড়ক সংস্কারের জন্য নতুন করে টাকা বরাদ্দ হবে। আবার লোপাট হবে এর বড় অংশ। ক্ষমতার সরকার কি পারছে বা চাচ্ছে এই বিষফোড়া থেকে মুক্তি পেতে?
সড়কে প্রতিদিন মানুষের প্রাণ ঝরছে। আমি জানি না এমন অনিয়ন্ত্রিত সড়ক দুর্ঘটনা আর কোনো দেশে হয় কি না। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, গত বছরে সড়কে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪,৭০২টি। দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছে ৫,২২৭ জন আর আহত হয়েছে ৬,৯৫৩ জন। এ বছর কোভিডের কারণে ক’মাস সড়কে গাড়ির চাকা না ঘোরায় দুর্ঘটনা থেকে কিছুটা রেহাই পেয়েছিলাম।
আবার গাড়ি চলতেই দুর্ঘটনা ঘটছে এখন। প্রতিদিনই ঝরছে তাজা প্রাণ। পুরো পরিবার শেষ হয়ে যাচ্ছে। সড়ক তাহলে কার নিয়ন্ত্রণে? সরকারের যে নিয়ন্ত্রণে নেই তা তো স্পষ্ট। অসুস্থ আর লোভী রাজনীতি যখন বেশি দাপুটে হয়ে যায় তখন মানুষের জীবন বিপন্ন হবেই। এ অবস্থায় উন্নয়নের বয়ান কি মানুষকে স্বস্তি দেবে?
প্রশাসনই যখন সরকার ও রাজনীতির দুর্বলতাগুলো জেনে ফেলে তখন এ প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করবে কে? তাই মাঠপর্যায়ে পুলিশের যে স্বেচ্ছাচারিতার কথা প্রতিদিন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে, সেখানে হস্তক্ষেপ করার নৈতিক শক্তি কি সরকারযন্ত্রের রয়েছে? আর এ প্রতিষ্ঠান যদি মানসিকভাবে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তাহলে ঘোর অন্ধকারে আমাদের নিমজ্জিত হতে হবে।
এই যে বছরের পর বছর স্বাস্থ্য খাতে অব্যবস্থাপনা চলছে, একে নিয়ন্ত্রণ করতে কি সরকার কোনো কার্যকর ভূমিকা নিয়েছে? কোভিডের কারণে ঝুলির বেড়াল যদি বাইরে না বেরোতো, তাহলে তো এতসব দুর্নীতির উপাখ্যান মানুষের সামনে এভাবে উন্মোচিত হতো না। এখন তো মনে হচ্ছে সব প্রতিষ্ঠানের ঝুলি ঝারলেই এমন বেড়াল বেরোবে।
ক’দিন পরপর খবর বেরোয় বাম্পার ফলনের ধান ঘরে ওঠার পরও চালের বাজারে লাগামহীনভাবে মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে। এ জন্য মিলারদের সিন্ডিকেটকে দায়ী করা হয়। এ সিন্ডিকেট এত শক্ত যে তা ভেঙে দেয়ার ক্ষমতা সরকার রাখে না। হতভাগ্য জনগণকে শেষ পর্যন্ত নিয়তির কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়।
ছাত্রলীগ-যুবলীগের সন্ত্রাস, খুনাখুনি আর দখলবাজি তো এখন গা-সওয়া হয়ে গেছে সাধারণ মানুষের। হয়তো সরকারেরও। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া নাকি এসব নিয়ন্ত্রণ করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর পক্ষে সম্ভব নয়। একইভাবে আরও একটি নতুন উপদ্রব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। যার নাম কিশোর গ্যাং। পারিবারিক শাসন উঠে গেছে।
শোনা যায় স্থানীয় রাজনৈতিক বড়ভাইরা নাকি এখন এদের অভিভাবক। রাজনৈতিক স্বার্থে এসব কিশোরকে ব্যবহার করা হয়। নানা প্রশ্রয়ে বখে যাওয়া কিশোররা প্রশ্রয় পেয়ে ছিনতাই থেকে খুনাখুনি সবই করছে।
একটি দেশের সরকার এতটাই দুর্বল যে, এসব উপড়ে ফেলতে পারছে না। কিশোরদের সুপথে আনার কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না। রাজনৈতিক সরকারের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না কিশোর গ্যাংয়ের অভিভাবকদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া।
এখন সাধারণ মানুষের কাছে স্পষ্ট, অর্পিত দায়িত্ব পালনে সরকার প্রতি পদে পদে ব্যর্থ হচ্ছে। নিদানে এখন মানুষ সরকারকেই যেন খুঁজে পাচ্ছে না। আসলে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ও নষ্ট রাজনীতির অপচ্ছায়া সরকারকে দুর্বল করে ফেলছে। এমন দুর্বলতা বজায় রেখে কোনো উন্নয়নই স্থায়ী রূপ পেতে পারে না। বর্তমান সরকারের সুশাসন প্রতিষ্ঠার যথেষ্ট সুযোগ থাকলেও তা ব্যবহার করতে পারছে না।
এটি খুবই হতাশার কথা। এখনও সাধারণ মানুষের আস্থার জায়গায় আছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। আমাদের শঙ্কার জায়গা হচ্ছে অন্যায় অবিচার থেকে মুক্ত করে দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য এ দেশে এখন বিকল্প কোনো রাজনৈতিক শক্তি নেই।
সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় স্নাত, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে এগিয়ে চলা আওয়ামী লীগ এবং এই দলের সরকার ন্যায় ও আদর্শচ্যুত হয়ে দুর্বল হয়ে যাক, তা দেশপ্রেমিক সচেতন মানুষ চাইবে না। সাধারণ মানুষ যদি ভাবে তারা প্রতারিত হচ্ছে, সরকার তাদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছে, তাহলে ঘুরে দাঁড়াতে তাদের সময় লাগবে না। এ দেশের হাজার বছরের ইতিহাস তাই বলছে।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়