ওদের জীবনের কি কোনো দাম নেই?

by | Jan 4, 2023 | Uncategorized | 0 comments

২৬ এপ্রিল ২০২২, দৈনিক যুগান্তর

ইংরেজ শিক্ষাবিদ ভিনসেন্ট আর্থার স্মিথ ১৯০৪ সালে ‘দ্য আর্লি হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া’ নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ লেখেন। বইটির এক জায়গায় তিনি লিখেছিলেন, প্রাচীন ভারতীয়রা অরাজকতা-প্রিয় ও বিশৃঙ্খল মানসিকতার ছিল। আমি আমার পিএইচডি থিসিসে বুক রিভিউ করতে গিয়ে এ জায়গাটিতে স্মিথকে সমালোচনা করেছিলাম। বলেছিলাম, স্মিথ এখানে ইতিহাস লেখার একটি সাধারণ ধারা ভুলে গিয়েছিলেন। ইতিহাসে অতীতের ঘটনা নিয়ে বর্তমানকে মূল্যায়ন করা যায়; কিন্তু বর্তমান দিয়ে অতীত মূল্যায়ন করা যায় না। তিনি যখন ইতিহাস লেখেন, তখন ভারতীয় বিপ্লবীরা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করছে। তখনকার পরিস্থিতি দেখে প্রচীনকালের ভারতীয়দের মানসিকতার ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আমার আশঙ্কা আমাদের দেশের বর্তমানের অসংস্কৃত অমানবিক রাজনীতিজাত সন্ত্রাসী ঘটনাগুলো দেখে আবার না ভবিষ্যতের কোনো ইতিহাস লেখক বাঙালির আবহমান বৈশিষ্ট্যকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেন।

অপরাজনীতি সূত্রে সংঘটিত কত সন্ত্রাসী ঘটনায় সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন হচ্ছে তা নিয়ে প্রতিবাদ করার ভাষাও যেন হারিয়ে ফেলছি আমরা। রাজনীতিসংশ্লিষ্ট ক্ষমতাবানরা এবং সরকারগুলোও অসহায় মানুষের পাশে সেভাবে দাঁড়াচ্ছে না। বরং এসবের ভেতর থেকে রাজনৈতিক লাভালাভ খুঁজে বেড়াচ্ছেন। এখন এমন এক অবস্থা বিরাজ করছে- কোনো দুঃসহ ঘটনা নিয়ে আলোচনা-প্রতিবাদের ঝড় তোলার আগেই নতুন ঘটনা ভুলিয়ে দিচ্ছে আগেরটিকে। আমরা দ্রুত তা ভুলেও যাচ্ছি।

অল্প সময়ের ব্যবধানে রাজধানীতে তিনটে মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড মানুষকে নাড়া দিয়েছে। তবে তা দায়িত্বশীলদের যে খুব ছুঁয়ে গেছে তেমন মনে হয়নি। শাহজাহানপুরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কোন্দলে গুলি করে হত্যা করা হয় থানা আওয়ামী লীগের নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপুকে। সন্ত্রাসীদের ছোড়া লক্ষ্যভ্রষ্ট গুলিতে রিকশা আরোহী ২২ বছর বয়সি নিরীহ কলেজ ছাত্রী সামিয়া আফরিন প্রীতি নিহত হলেন। একজন তরুণীকে জীবন অনুভব করার আগেই বিনা দোষে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হলো। রাজনৈতিক দলের নেতা বা সরকারপক্ষ দায়িত্ববোধ করলেন না অসহায় পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর। অতীতেও এ ধরনের সন্ত্রাস অনেক হয়েছে। তবুও রাজনৈতিক ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দিয়ে সাধারণ মানুষকে বিপন্ন করতে থাকলেন আমাদের রাজনীতি অঞ্চলের ক্ষমতাবানরা। ফলে এসব অপকীর্তির করুণ প্রতিক্রিয়ায় রাজধানীতে বিনাদোষে নিরীহ নাহিদ আর মুরসালিনের মতো দরিদ্র কর্মজীবীকে প্রাণ দিতে হলো সন্ত্রাসীদের আঘাতে। তরুণ নাহিদ স্বল্পবেতনের চাকরি করে সংসার নির্বাহ করত। মাত্র সাত মাস আগে বিয়ে করেছিল। কত স্বপ্ন বুনেছিল নিজের জীবন ও সংসার নিয়ে। অথচ মুহূর্তে নেমে এলো অন্ধকার। পত্রিকার পাতায় দোকান কর্মচারী মুরসালিনের স্ত্রী আর শিশুকন্যার আহাজারি চোখ ভিজিয়েছে, মনকে মুষড়ে দিয়েছে। এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেল এখনো জানলাম না নাহিদের পরিবারের পাশে ক্ষমতাসীন কোনো পক্ষ দাঁড়িয়েছে। তবে সম্প্রতি মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন সরকার পাশে দাঁড়াবে। অবশ্য বাস্তবে দেখছি বিবদমান রাজনীতির দুই পক্ষের নেতারা এসব বিবাদকে পুঁজি করে প্রতিদিনের দোষারোপের বাক্যবাণ ছুড়ে যাচ্ছেন। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মহোদয়কেও সক্রিয় দেখতে পেলাম না।

কেউ কেউ বলবেন, নাহিদ মুরসালিনের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক কী? কিন্তু সচেতন মানুষ জানেন শতভাগ সম্পর্ক রয়েছে। আর রয়েছে প্রশাসনের দায়বদ্ধতাও। নিউমার্কেটের দোকান কর্মচারী আর ঢাকা কলেজের ছাত্রদের মধ্যকার ছোট্ট ঝগড়া এক রাত এক দিনব্যাপী এমন ভয়াবহ রূপ নিতে পারল কীভাবে-এ এক বড় প্রশ্ন। মধ্যরাতের সংঘাত রাতেই পুলিশ প্রশাসন কোন ‘কৌশলগত’ কারণে সমাধান করতে পারল না তা বোঝার ক্ষমতা আমাদের নেই। পুলিশ প্রশাসন যদি মনে করে তারা ভেবেছিল সমস্যা মিটে গেছে, তাই দিনে সব ঠিক হয়ে যাবে। তাহলে প্রশ্নের তির যাবে নানা নামের গোয়েন্দাদের ওপর। খোদ রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে প্রায় প্রকাশ্য উত্তেজনার পরবর্তী প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে যদি গোয়েন্দারা সতর্ক করতেই না পারেন, তবে আমরা স্বস্তি খুঁজব কোথায়! নাকি নানা সময়ে শোনা যায়, রাজনীতি অঞ্চলের ক্ষমতাবানদের কূট হিসাবনিকাশ থাকায় নানা সময়ের মতো গোয়েন্দা রিপোর্ট আমলে আনা হয়নি?

নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী গ্রুপ ও ঢাকা কলেজের ছাত্রদের মধ্যকার সংঘাতের সূচনাটিতে হয়তো রাজনৈতিক উপাদান ছিল না; কিন্তু পরবর্তী প্রতিক্রিয়াটিকে কি নিরীহ বলা যাবে। ভোররাতে সেহরি খেতে উঠে টিভিতে যখন সংঘাতের চিত্র দেখলাম, তখন প্রকৃত কারণ না জেনে সরকারদলীয় ছাত্রদের চাঁদাবাজির প্রতিক্রিয়া বলে মনে হলো। কারণ দীর্ঘদিন থেকেই নিউমার্কেটসহ সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন সরকারের সময়ে সরকারদলীয় ঢাকা কলেজের ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসী গ্রুপ চাঁদার দাবিতে হামলা চালায়। ঈদের মতো পর্ব এলে এদের দৌরাত্ম্য আরও বাড়ে। মাঝে মধ্যে ব্যবসায়ীদের রুখে দাঁড়ানোর খবরও প্রকাশিত হয়েছে। এসব কারণে স্বাভাবিকভাবে আমার মতো অনেকেই মনে করেছেন, মধ্যরাতের সংঘর্ষের পেছনে চাঁদাবাজির কারণ জড়িয়ে আছে।

কিন্তু পরদিনের সংঘাতের প্রকৃতি দেখে আমার হিসাবে সামান্য পরিবর্তন এলো। প্রথমত, খটকা লাগল এ ধরনের সংঘাতে বা সংঘাতের আশঙ্কায় নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শরণাপন্ন হওয়ার কথা ছিল। এর বদলে তারা সংঘশক্তি নিয়ে মাঠে নামলেন কেন? তারা তো জানেন ঢাকা কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন কলেজ, বুয়েটসহ নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘিরে রেখেছে এ অঞ্চলের মার্কেটগুলোকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঘাপটি মেরে থাকা চাঁদাবাজরা ব্যবসায়ীদের অচেনা নয়। তাদের অনেকের সঙ্গে লেনদেনের আপসরফা রয়েছে। তাহলে তারা শক্তি প্রদর্শনে মাঠে নামল কেন? তা হলে কি ছাত্র পক্ষ, ব্যবসায়ী পক্ষ, গোয়েন্দা আর পুলিশ প্রশাসন আরও শক্তি প্রদর্শন দেখতে চেয়েছিল? অসহায় নাহিদ আর মুরসালিনের মৃত্যু দেখা পর্যন্ত সবাই কি সংঘাতের স্বরূপ খোঁজার চেষ্টা করেছে?

আমি নিউমার্কেটের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলাপ করে জানতে পারলাম, ঢাকা কলেজের রাজনীতি করা চাঁদাবাজ ছাত্রদের দ্বারা বরাবরই তারা নিপীড়িত। রাজনৈতিক নেতারা ও পুলিশ প্রশাসন তাদের আশ্রয় হতে পারেনি। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় তারা নিজেরাই প্রতিহত করবে ভেবে সংঘবদ্ধ হয়েছিল। সে রাতে ছাত্রদের সঙ্গে দোকান কর্মচারীর কথিত দুর্ব্যবহারের বিষয়টি ব্যবসায়ী সবার জানা ছিল না। ছাত্ররা চড়াও হলে তারাও চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য ভেবেছে। তাই তাদের প্রতিরোধ দল ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু প্রতিরোধের নামে আইন হাতে তুলে নেওয়া কি বিধিসম্মত? নাকি এতে সমস্যা মেটে? ছাত্ররা আক্রমণ করে অপরাধ করলে, একই অপরাধ করেছে ব্যবসায়ীদের সমর্থক সংঘাতকারী দল।

ঢাকা কলেজের সাউথ হোস্টেলে বসবাস করা রাজনীতিসংশ্লিষ্ট নয় এমন এক ছাত্রের সঙ্গে কথা হলো। তার বক্তব্য অনুযায়ী- হলগুলোতে এমনভাবে প্রচার করা হয়েছিল, অনেক ছাত্র নিউমার্কেটে আক্রান্ত। ফলে ছাত্রশক্তি মুহূর্তে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায়।

এতটাই নির্দয় আর বিবেকহীন হয়ে পড়েছি আমরা। টিভিতে দেখে লজ্জায় অধোবদন হয়ে পড়ছিলাম, সংঘাতে যুক্তরা কী নির্দয়ভাবে গাড়িতে রোগী বহন করা অ্যাম্বুলেন্স ভাঙছিল। গাড়ি ভাঙার অপসংস্কৃতি অবশ্য এদেশে আমরা সব সরকারের আমলেই দেখেছি। দলীয় সরকারগুলো দলীয় সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দিতে গিয়ে বিচারহীনতার সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। যত যৌক্তিক কারণেই হোক, দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন শুরু হলে হয়তো ‘কৌশলগত’ কারণে সরকার প্রথমদিকে নীরব থাকে। আর আন্দোলনকারীরা অভিজ্ঞতা দিয়ে দেখেছে ভাঙচুরের মতো অরাজকতা তৈরি না করা পর্যন্ত সরকার বিষয়টিকে আমলে নেবে না। এ কারণে সব আন্দোলনকারীর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে ভাঙচুর করা। যেন তারা কর্তৃপক্ষের ঘুম ভাঙাতেই ভাঙচুর করে।

মানুষ এখন চরম অসহায় অবস্থায় আছে। রাজনীতির বিবদমান পক্ষ নিজেদের সংঘাত-সংঘটনের পর নিজেদের রাজনৈতিক সুবিধার ফসল ঘরে তুলতে ইতোমধ্যে তৎপর হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। তারা মনে করে রাস্তায় বের হয়ে, গাড়িতে চড়ে বা বাড়িতে বসেও অনিরাপদ। তারা জানে না এ অসহায় অবস্থা থেকে কীভাবে মুক্তি পাবে? কোন পক্ষের কাছে অসহায় আকুতি জানাবে। নাকি অসহায় প্রীতি, নাহিদ আর মুরসালিনদের তালিকা বড় হতে থাকবে? এ দুর্ভাগারা রাজনীতির ক্ষমতাবান কেউ নন। এসব মূল্যহীন জীবন কাকেই বা নাড়া দেবে? পরিত্রাণের জন্য এখন সৃষ্টিকর্তাকে ডাকা ছাড়া আর কোনো পথ দেখছে না বিপন্ন মানুষ।

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

Pin It on Pinterest

Shares
Share This

Share This

Share this post with your friends!

Share This

Share this post with your friends!