২২ সেপ্টেম্বর ২০২০, দৈনিক যুগান্তর
আমার এক শিক্ষক বন্ধুর ধারণা, আমরা যারা কাগজে কলাম লিখি তারা রাজনীতিক ও আমলাদের শত্রু। আমলাদের অনেকে চান তাদের দাপুটে জীবন নিয়ে কেউ সমালোচনা না করুক আর রাজনীতিকরা, বিশেষ করে ক্ষমতার রাজনীতিতে শক্তিমান যারা তারা নানা অপকীর্তির জন্য মানসিকভাবে দুর্বল বলেই দুর্মুখ সাংবাদিক আর কলামিস্টদের সহ্য করতে পারেন না।
ক্ষমতার রাজনীতিক এবং আমলা একে অন্যের স্বার্থরক্ষার পরিপূরক বলে তাদের কমন শত্রু সাংবাদিক ও কলাম লেখকরা। তবে এ কথা সত্য, আমরা অনেক সময় অনেক কথার বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে পরিস্থিতি জটিল করে তুলি।
সেদিন সদ্য অবসরপ্রাপ্ত একজন সাবেক উচ্চপদস্থ সরকারি আমলা বন্ধু মজা করেই বলল, এখন নাকি লেখালেখি থেকে অবসর নিতে হবে আমাদের। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমলাদের সাহস বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি লেখালেখিকে পাত্তা না দিয়ে কাজ করে যেতে বলেছেন। এখন আমলারা আরও দৃঢ়তায় কর্ম-অপকর্ম করে যেতে পারবেন।
আমি বললাম, একটি ভালো উক্তিকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে আপনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা করে ফেললেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন সততা আর শুদ্ধতার সঙ্গে কাজ করে যেতে। এ পথে চলতে গিয়ে কোনো সমালোচনা বা লেখা যদি দ্বন্দ্ব তৈরি করে পিছুটানের কারণ হয়, একে আমলে না আনতে বলেছেন।
তবে আমি আমার বন্ধুর সঙ্গে একমত হয়ে বলি: এ দেশে যা বলা হয় আর প্রকৃত প্রস্তাবে যা ঘটে এর মধ্যে অনেক ফারাক আছে। এই যে সরকার যখন সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন প্রায় ডবল করে দিল, তখন একটা প্রত্যাশার কথা বলেছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
বলেছিলেন, এবার বেতন বেড়েছে তাই আর ঘুষ-দুর্নীতির আশ্রয় নিতে হবে না। কিন্তু বাস্তবে কি তেমন অবস্থা আমরা দেখেছি? বরঞ্চ নাগরিক হিসেবে আমরা যখন সেবা পেতে সরকারি দফতরগুলোয় যাই তখন ঘুষের অক্টোপাস আরও বেশি আঁকড়ে ধরে।
রাস্তাঘাট বানানো শেষ না হতেই ছাল-বাকল উঠে যাওয়া শুরু হয়। ইতোমধ্যে দেশের পরিবহন সেক্টর আর ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট সাধারণ মানুষের কাছে প্রমাণ করেছে তারা সরকারের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। তাই বেপরোয়া সড়ক দুর্ঘটনা আর জীবনহানির সূচক শুধু ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। মন্ত্রী মহোদয়দের জবানি ভুল প্রমাণ করে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে বাজার।
১৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর এক সুপার শপে অভিযানে নেমেছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট; যা এক টিভি চ্যানেল প্রচার করছিল। তাতে দেখা গেছে দেশি পেঁয়াজ ২ কেজির প্যাকেট ২০২ টাকা। আমদানিকৃত পেঁয়াজ ৯৫ টাকা কেজি। ততক্ষণে ভারত ও মিয়ানমারের পেঁয়াজ দেশে ঢুকেছে। আড়তে দাম কমে যাচ্ছে; কিন্তু খুচরা বাজার যেখান থেকে সাধারণ মানুষ ক্রয় করবে সেখানে দাম কমছে না।
ম্যাজিস্ট্রেট ব্যাখ্যা করলেন, পেঁয়াজের আমদানিমূল্য পড়ছে ৩৬ টাকা। আমদানিকারক, আড়ত ইত্যাদি ঘুরে খুচরা বাজারে ৯০-৯৫ টাকা হয়ে যাচ্ছে। ম্যাজিস্ট্রেটের জবানি অনুযায়ী বিভিন্ন পর্যায়ে কেজিতে ৩০ টাকার উপরে মুনাফা করছে ব্যবসায়ীরা, যা অস্বাভাবিক।
কিন্তু এদের রুখতে কি পারা গেছে কখনও? রাজনীতি শুদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত এদের ওপর খবরদারি করার শক্তি পাবে না রাষ্ট্রের কোনো সংগঠন। বাজারে, পথেঘাটে সাধারণ মানুষ মার খেয়েই যাবে।
বড় আমলা থেকে সাধারণ কর্মচারী যারা স্বভাবে সৎ, তারা বেতন না বাড়ালেও অসৎ হয়ে যান না। খাওয়া-পরায় বিলাসিতা না করতে পারলেও শান্তিতে থাকেন। অনেক আগে অবসরপ্রাপ্ত আমার এক নিকটাত্মীয় রেলওয়ের বড় প্রকৌশলী ছিলেন।
চট্টগ্রামে পাহাড়ের ওপর তার সরকারি বাংলোয় বেড়াতে গিয়েছিলাম একবার। বাড়িতে বিলাসব্যসন বলতে কিছু নেই। খুবই সাদামাটা। শুনেছি নিরেট সৎমানুষ তিনি। তার বড় ভাই (বর্তমানে প্রয়াত) ঠিকাদারি ব্যবসা করেন। জেনেছি সংসার চালানোয় খরচে টান পড়লে এই ভাই জোগান দিতেন।
আমার পরিবারের ঘনিষ্ঠ এক দম্পত্তির কথা বলব। দুজনেই সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। আমার জানামতে, সততা নিয়েই দিন যাপন করেন। তবে বেশ ভালো আছেন। একদিন ওরা সহমর্মিতা জানিয়ে বলল, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার জীবন প্রায় শেষ করে ফেললেন, তারপরও শেষ জীবনের জন্য বড় কোনো পুঁজি নেই। পৈতৃক বাড়ি আছে বলে বেঁচে গেছেন।
আমরা যে পজিশনে চাকরি করছি তাতে সরকার যে ব্যবস্থা করে দিয়েছে তা দিয়ে সততার সঙ্গে থেকেও ভালো আছি আমরা। প্রায় নিখরচায় গাড়ি পেয়েছি। মেইনটেন করার জন্য যে বরাদ্দ পাই তা দিয়ে লোনের কিস্তি শোধ করা যায়।
আমাদের দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান ভাতা আর অ্যালাউন্স যা মাসে থাকে, তাতে বেতনের টাকা না ধরলেও চলে। এরপর প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে মাঝেমাঝেই বিদেশ টুর করি- তাতেও ভালো আয় হয়। এসবের পরও যারা দুর্নীতি করেন তাদের ক্ষুধা কখনও মিটবে না।
শুদ্ধাচারী কর্মকর্তাদের সাহস দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তারা যেন পাছে লোকে কিছু বলাতে থমকে না গিয়ে নিজেদের দায়িত্বটা সুসম্পন্ন করেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভরসার পর আর কোনো কথা থাকে না। তবুও আমরা যেহেতু নানা অসঙ্গতি-অন্যায় দেখলে তা লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করার চেষ্টা করি তাই আমরাও বলতে চাই, অন্যায় না করলে তার আবার ভয় কী? সততার শক্তিতে এমনিতেই সে বলীয়ান।
সাংবাদিক আর কলাম লেখকরা কি সৎ ও শুদ্ধাচারীদের বিরুদ্ধে লেখেন? যারা অন্যায়কারী তারাই না ভীত হবে, বিব্রতবোধ করবে অথবা অতি শক্তিমান হলে অবজ্ঞা করবে। সবার গায়ে তো সব কথায় ফোসকা পড়ে না। যার চামড়া নাজুক তাদের গায়ে ফোসকা পড়তে পারে। যেমন, দিন কয়েক আগে টেলিভিশনে একজন মাননীয় মন্ত্রীর ক্ষোভ দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম।
দেশবাসী মোটের ওপর জানে প্রাইমারি স্কুলের শিশুশিক্ষার্থীদের জন্য মিড-ডে মিলের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জ্ঞান নিতে পাঁচশ কর্মকর্তাকে (প্রথমে শোনা গিয়েছিল এক হাজার) বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। দেশে তো হরদম এ ধরনের ভ্রমণের কথা শোনা যায়। পুকুর কাটার প্রশিক্ষণেও বিদেশে কর্মকর্তাদের পাঠানোর কথা শুনি।
শিক্ষকের বদলে আমলারাই যান বিদেশে স্কুল শিক্ষা কার্যক্রম পরিদর্শনে। ভ্রমণ শেষে দেশে ফিরে হয়তো শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বদলি হয়ে যেতে হয় কৃষি মন্ত্রণালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী তরুণ শিক্ষক উচ্চতর গবেষণার জন্য স্কলারশিপ জোগাড় করতে না পেরে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েও যেতে পারেন না।
আর তেমন আবশ্যিক না হলেও সরকারি টাকায় অনেক পদস্থ কর্মকর্তা অনায়াসে বিদেশে পড়াশোনা করে আসেন। আমরা মনে করি, মানুষ মোটামুটি এসবে ধাতস্থ হয়ে গেছে। কিন্তু ‘খিচুড়ি রান্না প্রশিক্ষণের জন্য ৫০০ কর্মকর্তা ৫ কোটি টাকা বাজেটে বিদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত ছিল প্রকল্পে’ এমন ধরনের রিপোর্ট বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার পর সিদ্ধান্ত স্থগিত হয়ে যায়।
টেলিভিশনে চোখ রেখে মনে হল এতে মন্ত্রী মহোদয় ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি একহাত নিলেন মিডিয়ার ওপর। মিডিয়া না বুঝেই রিপোর্ট করেছে। এটি খিচুড়ি রান্না নয়- শত শত স্কুলে খাবার ব্যবস্থাপনার জন্য বিদেশে প্রশিক্ষণ নেয়াটা জরুরি। আর ‘সামান্য কিছ– টাকা’ বরাদ্দ ছিল এর জন্য। আমি বুঝতে পারলাম না খিচুড়ি রান্না ও খাবার ব্যবস্থাপনার প্রশিক্ষণের মধ্যে কতটা তফাত রয়েছে।
স্কুলে বাচ্চাদের টিফিন দেয়ার ব্যবস্থাপনা স্কুলগুলো আগেও করেছে। না হয় এই মিড-ডে মিলের আয়তন আরেকটু বড়। আর বাঙালি কি এতই কাণ্ডজ্ঞানহীন জাতি যে, নিজেদের বুদ্ধি-বিবেচনা আর দক্ষতায় দেশজুড়ে এটুকু ব্যবস্থাপনা করতে পারবে না? এর জন্যও বিদেশে গিয়ে শিখে আসতে হবে!
আমার বছর দশ-বারো আগের একটি স্মৃতি মনে পড়ল। গাজীপুরের লোহাগাছিয়ায় এক পীর পরিবারের মায়ের মৃত্যুর চল্লিশার দাওয়াতে গিয়েছিলাম। ১০ হাজার অতিথির নিমন্ত্রণ ছিল। ডেগের পর ডেগ বিরিয়ানি রান্না হচ্ছে। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খাওয়াপর্ব চলবে। এখনও চাষ শুরু হয়নি এমন কয়েকটি কৃষিজমিতে পাটি বিছিয়ে একসঙ্গে শত শত অতিথি খেতে বসেছেন।
দেখলাম বেশকিছ– স্বেচ্ছাসেবক তরুণ বুকে ব্যাজ লাগিয়ে প্রস্তুত। কারও ব্যাজে লেখা পানি, কারও বিরিয়ানি, কারও লবণ। এমনি করে কাজ ভাগ করে দেয়া আছে। আমি বিস্মিত হয়ে দেখলাম এত বিশাল পরিবেশনা সুশৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন হচ্ছিল।
কথা বলে জানলাম গ্রামে বড় কোনো আয়োজন থাকলে আশপাশের কয়েকটি গ্রাম মিলে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেয়। বিদেশে না গিয়েও গ্রামের তরুণরা নিজ অভিজ্ঞতায় প্রশিক্ষিত। সব গ্রাম থেকে পাঠানো স্বেচ্ছাসেবকদের অংশগ্রহণে ওরা সুসম্পন্ন করে সামাজিক কাজ।
মন্ত্রী মহোদয়দের কাছে সামান্য হলেও আমাদের মতো সাধারণের কাছে ৫ কোটি অনেক টাকা। এ টাকা দিয়ে প্রাইমারি স্কুলের অনেক জরুরি চাহিদা মেটানো যায়।
সবচেয়ে দুর্ভাগ্য, ক্ষুব্ধ মন্ত্রী মহোদয় প্রচলিত রাজনৈতিক বক্তব্যের ধাঁচে ‘ভুলভাল’ রিপোর্ট প্রকাশের জন্য বিএনপি-জামায়াত মতাদর্শের মিডিয়াগুলোকে দায়ী করলেন; কিন্তু আমার দেখামতে, দেশের অধিকাংশ প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া ‘খিচুড়ি রান্নার’ প্রশিক্ষণের কথা প্রচার করেছে। আর এসব মিডিয়ার অধিকাংশই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কাগজ ও টেলিভিশন। সবাইকে যদি বিএনপি-জামায়াত বলে দূরে সরিয়ে দেয়া হয়, তাহলে তো সঙ্গত প্রশ্ন উঠবে- আপনাদের পক্ষে কে?
আমাদের মনে হয়, ক্ষমতাবানরা ভুলে যান রাষ্ট্রের সব অর্থ জনগণেরই। বিদেশি অনুদান বা ঋণের দায় জনগণকেই বহন করতে হয়। সরকার ও এর নানা অঙ্গ শুধু এসবের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে নিয়োজিত। সুতরাং জবাবদিহিতা চাওয়ার অধিকার মানুষের রয়েছে। আর জনগণের পক্ষ থেকে এ দায়িত্ব গণমাধ্যম পালন করে।
আমরা যারা কলাম লিখি তারা জানি এসব দুর্নীতিবাজ ও ক্ষমতাবান আমাদের লেখাকে থোড়াই কেয়ার করে। বুঝতে হবে, আমরা তাদের কেয়ার করানোর জন্য লিখি না। আমরা লিখি জনগণকে সচেতন করার জন্য। কারণ, আমরা বিশ্বাস করি, জনগণ সচেতন হলেই শুধু সব নষ্ট মানুষ সতর্ক হবে। সুপথে ফিরতে বাধ্য হবে।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়