১৩ এপ্রিল ২০২১, দৈনিক যুগান্তর
লেখার শুরুতেই ঢাকার নবাবদের প্রতিষ্ঠাকালীন একটি কথা আমার মনে পড়ল। ঢাকার নবাবদের প্রতিষ্ঠাতা কে তা নিয়ে কিছুটা বিতর্ক রয়েছে। এসএম তাইফুর তার ‘Glimpses of old Dacca’ গ্রন্থে লিখেছেন, ঢাকার নবাব বংশের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল ওয়াহাব। তার দুই ভাই হাফিজউল্লাহ ও আহসানউল্লাহ (নবাব আবদুল গণির ছেলে খাজা আহসানউল্লাহ নন) ঢাকায় প্রথম বসবাস করেন। হাফিজউল্লাহ পীর হিসাবে পরিচিত ছিলেন।
ঢাকায় নবাবি পত্তনের আগে তারা ছিলেন ব্যবসায়ী। ব্যবসা করে প্রভূত ধনসম্পদের মালিক হন। মৃত্যুকালে হাফিজউল্লাহর একটি পরামর্শ এ পরিবারের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দেয়। হাফিজউল্লাহ বলেছিলেন, ব্যবসা বন্ধ করে সব টাকা দিয়ে জমি কিনতে। এ ক্ষেত্রে তার দুটো উপদেশ ছিল, ১. জমি কিনতে হবে চরাঞ্চলে। অর্থাৎ অল্প দামে বেশি জমি; ২. তাদের জমিদারিতে কৃষক মুসলমান হলে নায়েব রাখতে হবে হিন্দু সম্প্রদায় থেকে। আর কৃষক বেশি হিন্দু সম্প্রদায়ের হলে নায়েব হতে হবে মুসলমান। হাফিজউল্লাহ দূরদৃষ্টি দিয়ে দেখেছিলেন কৃষক ও নায়েব একই সম্প্রদায়ের হলে পারস্পরিক নৈকট্যের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে।
আরেকটি উদাহরণ দেই। পলাশীর যুদ্ধের সূত্রে ঘটনাচক্রে বাংলা এবং ভারতের শাসন ক্ষমতা চলে আসে ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে। ব্যবসায়ীরা ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করবে এমন প্রস্তুতি হয়তো ইংল্যান্ড প্রশাসনের তখনও ছিল না। ঔপনিবেশিক শাসনের কিছু ফর্মুলা রয়েছে। অধিকৃত দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অধিবাসীরা ইংরেজ শাসনে সন্তুষ্ট থাকবে। আর সেই সুযোগে সম্পদ পাচার করবে নিজ দেশে।
এসব শিখিয়ে-পড়িয়ে দিয়েছিল হয়তো স্বদেশি বণিক শাসকদের। বণিক তো রাজনৈতিক-ধর্মের কথা শোনে না। সে দেখে পুঁজি আর লভ্যাংশ। তাই একশ বছরে খেপিয়ে দিল ভারতবাসীকে। এ সূত্রেই সংঘটিত হলো স্বাধীনতার যুদ্ধ। ইংরেজদের ভাষায় সিপাহি বিদ্রোহ। টনক নড়ল ইংল্যান্ডের প্রিভি কাউন্সিলের। বুঝলেন বণিকদের দিয়ে দেশ চালানো সম্ভব নয়। এরা বণিক স্বার্থকেই সবার আগে দেখবে। এ কারণে কোম্পানি শাসনের অবসান ঘটিয়ে রানি ভিক্টোরিয়ার শাসন অর্থাৎ ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হলো।
এসব ইতিহাসের শিক্ষা আমাদের রাজনীতিকরা ধারণ করেন না। তারা ভবিষ্যৎকে অন্ধকারে ফেলে তাৎক্ষণিক লাভ পেতে চান। তাই পার্টি ফান্ড মজবুত করতে গিয়ে পোড়খাওয়া রাজনীতিকদের এক পাশে ঠেলে বণিকদের রাজনীতির উচ্চাসনে বসাতে থাকেন। এভাবে আমাদের রাজনীতির ভিত দুর্বল হতে থাকে।
বর্তমান আওয়ামী লীগের দীর্ঘ রাজনীতি চর্চায় বেড়ে ওঠা নেতানেত্রীরা মুখে না বললেও সত্যটি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। বণিক বুদ্ধি নিজেদের অবস্থান ঠিক রাখতে অনেক রাজনীতিবিদকেও গোপন পথে বণিক বানিয়ে দেন। এভাবে নিজেরা নিরাপদ হয়ে যান; কিন্তু এসব বাস্তবতায় বড় ক্ষতি হয়ে যায় প্রকৃত রাজনীতির। এর কুপ্রভাব কি দেখছি না আমরা?
বছরের পর বছর পার হচ্ছে, কখনোই বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সরকার। চালের বাজার অস্থিতিশীল থাকছে। চালের সরকারি মজুতের কথা শুনে বা আমদানির খবরও বাজারে প্রভাব ফেলছে না। খুচরা ব্যবসায়ী দোষ দিচ্ছে পাইকারদের। পাইকারি ব্যবসায়ী দোষ দিচ্ছে মিলারদের। এ নাটক চলছেই। আর এর মাঝখানে ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে থাকছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়। নিত্যপণ্যের একেকটি ধরে বলার কিছু নেই।
বরঞ্চ বলা ভালো, কোনো পণ্যের লাগাম টেনে ধরতে পারছে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন! বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মাঝে মাঝে মুখ খুলে। ব্যবসায়ীদের পক্ষে সাফাই গেয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বেড়েছে। এসব শুনে প্রশ্ন জাগে, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির আগে আনা মজুত পণ্য কেন আগের দরে বিক্রি হবে না বা কোনো পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য কমলেও এদেশে এর প্রভাব পড়ে না কেন!
আমার প্রয়াত শিক্ষক গল্প করতেন, ‘এক মুচির মেধাবী ছেলে পড়াশুনা করে বড় সরকারি আমলা হয়েছেন। একবার গ্রামে কোনো এক অভিযোগের তদন্তে যাচ্ছেন। সাথে লোক লস্কর। হঠাৎ দেখেন অনেক শকুন উড়ে যাচ্ছে। সাথের লোকদের এই আমলা বললেন খোঁজ নিয়ে দেখো কোথাও গরু মরেছে।’ গল্প শুনিয়ে স্যার বলতেন পোশাক পালটালেও স্বভাব সহজে যায় না। একইভাবে আমরা বলব, পোশাক পালটালেও বণিক স্বার্থ জনস্বার্থকে সাধারণত প্রাধান্য দিতে পারে না।
এসব কারণে সংকটে মানুষ যখন বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে, তখন সরকারের পক্ষ থেকে ‘কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে’, বা ‘কাউকে ছাড় দেয়া হবে না’ ধরনের বক্তব্য এলে স্বস্তি না পেয়ে কৌতুক রসের আনন্দ হয়তো পায় সাধারণ মানুষ। প্রত্যেক রোজার আগেই সরকারি পক্ষের বুলি থাকে এবার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকবে। কিন্তু অল্পদিনেই এ বাস্তবতা বানের জলে ভেসে যায়। এবারও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই মানতেই হবে বাজারের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
মৃত্যু সংঘটনের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের সড়ক তো করোনা মহামারির চেয়েও ভয়ংকর। পরিবহণ মালিক সংগঠনের নেতাদের হাতে রেখে বা রাজনীতিবিদ শ্রমিক নেতাদের মন্ত্রী বানিয়েও তো সড়ক নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। এখানেও এক কথা, বণিক স্বার্থের কাছে সবকিছুই পর্যুদস্ত। এর সঙ্গে যুক্ত হয় আমলা স্বার্থ। এত লেখালেখির পরও সড়কে ফিটনেসবিহীন গাড়ির অভাব নেই। অভাব নেই লাইসেন্স ছাড়া ড্রাইভারের।
আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, পরিবহণ মালিক ও শ্রমিকদের অপরাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করে এতটাই মাথায় চড়ানো হয়েছে, যে কোনো আইন দিয়েও এদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। কোনো পরিবহণ শ্রমিক অপরাধ করলেও পুলিশ তাদের গ্রেফতার করতে পারবে না। করলেই এদের সংঘবদ্ধ শক্তি একাট্টা হয়ে অচল করে দেবে সড়ক। অবস্থা এমন, অপরাধ অনুযায়ী আইনও পাশ করা যাবে না। সংঘশক্তির কাছে পরাজয় স্বীকার করে বাধ্য হয়ে নতজানু নীতি গ্রহণ করতে হবে সরকারকে। এমন বাস্তবতায় সড়কের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকবে কেমন করে!
এসব দেখেই সম্ভবত অন্ধ সমর্থকের দল তৈরি করে ইসলামকে রক্ষা করবে বলে একটি সংগঠন উন্মত্ততা ছড়িয়ে সরকারকে জিম্মি করতে চাইছে। বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের আগমন ও বিস্তারের ইতিহাস বড়জোর এক হাজার বছরের। ধীরে ধীরে এদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে পরিণত হয়। মধ্যযুগের মুসলমান শাসনপর্বের প্রায় ৬০০ বছর অমুসলিম প্রজার সঙ্গে সুলতান ও মোগল সুবেদাররা সহজ সম্পর্ক তৈরি করেছিলেন।
ইসলাম প্রচারে প্রধান ভূমিকা রাখা সুফিসাধকদের নীতিতে ইসলামের সহজ মানবিক দিকের চর্চা থাকায় সাম্প্রদায়িক সংকট তৈরি হয়নি কোথাও। হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক প্রয়োজনে সেখানে ভাঙন ধরায় ইংরেজ শাসকরা। উনিশ শতকে মুসলমান সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করতে ফরায়েজি আন্দোলন শুরু করেছিলেন হাজী শরীয়তউল্লাহ। কিন্তু তিনি সাম্প্রদায়িক ঈর্ষা ছড়িয়ে দেননি। কোনো জেহাদি মনোভঙ্গিরও প্রকাশ করেননি।
পাকিস্তান শাসনপর্বে রাষ্ট্রীয়ভাবে দেশটি ছিল ইসলামী প্রজাতন্ত্র। তারপরও পাকিস্তান আমলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধাবাদীরা কয়েকটি হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা সংঘটনে ভূমিকা রাখলেও সাধারণ হিন্দু-মুসলমানদের সম্পর্কে তেমন ফাটল ধরেনি। মোগল আমল থেকে শিয়া সম্প্রদায়ের প্রবেশ ঘটতে থাকে বাংলায়। শত শত বছর পার হলেও ভিন্ন সংকটে ইংরেজ শাসন যুগে একবার ও বিগত জঙ্গি আক্রমণ পর্বে একবার এদেশে শিয়াদের ওপর আঘাত এসেছিল। এ ছাড়া দুই সম্প্রদায় শান্তিপূর্ণভাবেই বসবাস করে আসছে বহুকাল ধরে।
স্বাধীন বাংলাদেশ পর্বে জিয়াউর রহমানের সময় একবার এবং জেনারেল এরশাদের সময় একবার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অপ্রয়োজনে সংবিধানে ইসলামী পারফিউম লাগানোর কাজটি করা হয়। রাজনৈতিক কারণেই আওয়ামী লীগ এবং এর সরকারও মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত সংবিধানকে নিষ্কলুষ করতে সাহস দেখায়নি।
যেভাবেই হোক, এ দেশে ইসলাম যুগ যুগ ধরে এর স্বাভাবিক সৌন্দর্য নিয়েই নিজের বিকাশ ঘটিয়েছে। কখনো ইসলামকে এ দেশে বিপন্ন মনে হয়নি। পূত পবিত্র চরিত্রের আলেম সমাজও তেমন কথা কখনো বলেননি। হঠাৎ দেখলাম আলেম সমাজের আলখেল্লায় একটি সংঘবদ্ধ শক্তির উত্থান ঘটল। তারা নিজেরাই নিজেদের ইসলামের রক্ষাকারী হিসাবে ঘোষণা দিল। নিজেদের বিশেষ ধারার মাদ্রাসার নেতৃত্বে থেকে সাধারণ সরল তরুণদের একটি গণ্ডির ভেতর আটকে রেখে ওদের বিবেক ও জ্ঞান চক্ষুকে তালাবদ্ধ করে হুকুমের দাস করে ফেলেছে।
নিজেদের সুবিধার জন্য ওদের লাঠিয়ালের মতো মাঠে নামিয়ে ইসলামের সৌন্দর্যে কালিমালেপন করছে। প্রাচীন বাংলায় ব্রাহ্মণ সেন শাসকরা সুবিধাবাদী পুরোহিতদের দিয়ে হিন্দু ধর্মের অপমান করেছেন। মধ্যযুগে ইউরোপে একই মানসিকতার পোপরা কলুষিত করেছেন খ্রিষ্টান ধর্মকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামীর মতো ইসলামের সাইনবোর্ড টানানো লেবাসধারীদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছে ইসলামী আদর্শ।
এ যুগেও অভিন্ন উদ্দেশ্যে কালিমালেপন করা হচ্ছে ইসলামের সৌন্দর্যে। অথচ যে অপশক্তিকে সুপথে আনার চেষ্টা নেওয়া উচিত ছিল তাদেরই রাজনৈতিক প্রয়োজনে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। এখন এরা সদম্ভে এ দেশের মানুষের স্বাভাবিক জীবনে বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে। তাদের নেতাদের পর্দার অন্তরালের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক লিপ্সার পাশাপাশি চারিত্রিক স্খলনের চিত্রও দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ছে।
সাধারণ মানুষ, দেশ ও ইসলামের জন্য বিপজ্জনক এসব আসুরিক শক্তিকে সরকার কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে তা দেখার বিষয়। তবে আমরা বর্তমান বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে সরকার পরিচালকদের বলব, এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আপনাদের অবদান কম নয়। তবে বর্তমান বাস্তবতায় সাধারণ মানুষের কষ্টের কারণ অনিয়ন্ত্রিত বাজার, সড়ক ও ইসলামের নব্য রক্ষাকারীদের (!) যদি নিয়ন্ত্রণের গণ্ডিতে আটকাতে না পারেন, তাহলে সব অর্জনই ফিকে হয়ে যেতে পারে।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected] ১৩ এপ্রিল ২০২১,