দলীয়করণে ক্ষতি হচ্ছে বেশি

by | Jan 4, 2023 | আমার লেখা | 0 comments

২০ অক্টোবর ২০২২, দৈনিক যুগান্তর

গল্প করছিলেন কোনো এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মী। সেখানে উপাচার্য অবসরে যাবেন। এ সময় যা হয় সেখানেও তা-ই হলো। প্রত্যাশী অনেক অধ্যাপক ছোটাছুটি শুরু করলেন। এ দৌড়ের মিছিলে এমন দু-একজনের নামও জানা গেল, যা শুনে অনেককে বিস্মিত হতে হলো। বিস্ময় এজন্য যে, একাডেমিক দিক বিচারে তাদের শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পাওয়াটাই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। তাছাড়া শিক্ষকজীবনে তার বা তাদের বিরুদ্ধে ছিল নানা অন্যায় কর্মের অভিযোগ। তদন্তও হয়েছে।

আমার সহকর্মী জানালেন, উপাচার্য হিসাবে গোয়েন্দা সংস্থা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে যে সংক্ষিপ্ত তালিকা পাঠিয়েছিল, সেখানে এমন একজন অধ্যাপকের নামও ছিল। আমার সহকর্মী কথা বলেছিলেন তার পরিচিত অবসরপ্রাপ্ত একজন অফিসারের সঙ্গে। জিজ্ঞাসা করেছিলেন, গোয়েন্দা তালিকায় এ ধরনের নাম যায় কী করে! যে উত্তর পেয়েছেন, তার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না তিনি। তিনি জানলেন, যে ছক তারা পূরণ করেন, সেখানে নাকি একাডেমিক কৃতিত্ব গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ছাত্রজীবন থেকে তিনি সরকারি দলের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন কি না। শিক্ষকজীবনে সরকারি দলের রাজনীতিতে কতটা সক্রিয় ছিলেন। এসব বিচারে উল্লিখিত অধ্যাপক অনেক নম্বরে এগিয়ে ছিলেন।

এ ধরনের শিক্ষকরা যখন উপাচার্য হন, তখন নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য দলীয় ছাত্রসংগঠনের পৃষ্ঠপোষক হতে হয়। দলীয় শিক্ষকরাই তাকে ঘিরে রাখেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্র অকর্ষিত হতে হতে বন্ধ্যা হয়ে পড়ে। ছাত্ররাজনীতির তালিকায় নাম না থাকলে এবং তদবির করার জন্য মন্ত্রী, এমপি বা দলীয় বড় নেতা না থাকলে ভালো ফলাফল করা শিক্ষার্থীদের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন মিলিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত তাদের অনেকেই হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন।

এমন দলীয়করণের একটি ঘটনা আমি প্রত্যক্ষ করেছিলাম। ১২-১৪ বছর আগের কথা। আমার এক মেধাবী ছাত্রী সদ্য মাস্টার্স শেষ করেছে। সে শুধু মেধাবীই নয়, সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতেও সবল পদচারণা তার। আমি ব্যক্তিগতভাবে তদবির করা ও তদবির পাওয়া দুটোই অপছন্দ করি। আমি জানি, আমার ছাত্রীও এ ধারারই। একদিন ও বিমর্ষ মুখে এলো। সে প্রভাষক পদের জন্য আবেদন করেছে। কিন্তু শুনেছে, রেজাল্টই সব কিছু নয়-শক্ত তদবির লাগবে। বলল, স্যার আমি তদবির করিয়ে শিক্ষক হতে চাই না। আমি চাই না নিয়োগ কমিটির ফেভার পেতে। চাই নিয়োগ কমিটি নিরপেক্ষ থাকুক।

ওর আবেদনটি আমার মন ছুঁয়ে গেল। মনে পড়ল সরকারি দলের একজন প্রভাবশালী অধ্যাপক বন্ধুর কথা। ওরা চাইলে নাকি অনেক কিছু করতে পারে। আমি আমার ছাত্রীর আর্জিটুকু পৌঁছে দেওয়ার জন্য বন্ধুর কাছে গেলাম। বললাম, দেখো মেয়েটির প্রতি যাতে সুবিচার হয়। আমার আশা ছিল বন্ধু প্রার্থীর একাডেমিক যোগ্যতার বিষয়ে জানতে চাইবে।

কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ও প্রশ্ন করল, ‘মেয়েটি কি ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ করেছে?’ আমি জানি, এ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব আমার মতো মেয়েটিও পালন করেনি। ও দলনিরপেক্ষ পরিচয় নিয়েই ছাত্রজীবন শেষ করেছে। আমি মেয়েটিকে জানিয়ে দিলাম-শুধু শুধু আশাবাদী না হওয়াই ভালো।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়ার এমন তরিকা এখন ওপেন সিক্রেট। শুধু শুধু আলোচনায় এনে লাভ নেই। আমাদের উচ্চশিক্ষাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করার একটি মহাপরিকল্পনা যেন চলছে। সব ধ্বংস হোক, শুধু রাজনীতি আর ক্ষমতা বেঁচে থাক। কোনো এক জাতীয় দৈনিকে সম্পাদকীয় বিভাগের দায়িত্বে আছেন আমার এক বন্ধু।

কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নিবেদিত কর্মী ছিলেন। এখনো আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু অন্তঃপ্রাণ। আমার কাছে তার পত্রিকার জন্য প্রায়ই শিক্ষাসংক্রান্ত লেখা চান। রাজনীতিকরণের মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষার্থীদের জীবন যে বিপন্ন করা হচ্ছে, তা নিয়ে তিনি চিন্তিত। বললাম, সত্য সমালোচনা করি বলে মেইলে বকাঝকা খাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে আমার। বিএনপির সমালোচনা থাকলে বকাঝকা আসে বিএনপি কর্মী-সমর্থকদের কাছ থেকে। আর আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করলে বকাঝকা আসে এপাশ থেকে। কেউ কেউ আমাকে বিএনপি-জামায়াতভক্ত বানাতেও দেরি করে না।

বুঝতে পারি, এরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করেন না। লেবাসি আওয়ামী লীগ আর ছাত্রলীগ হয়তো। আমি আমার সাংবাদিক বন্ধুকে বলি, আপনার জেনুইন ছাত্রলীগ ব্যাকগ্রাউন্ড থাকার পরও শিক্ষাব্যবস্থায় অসুস্থ রাজনীতিকরণের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করতে আমাদের অনুরোধ করেন কেন? জানালেন, তার ছেলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। মেধাবী ছেলেটি ভালো ফলাফল করার প্রত্যাশা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। তাই ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত হয়নি। এখন ছাত্রলীগের পীড়ন ও প্রশাসনের দলীয়করণ দেখে ও হতাশ। আমি আমার বন্ধুটির বাস্তবতার উঠোনে দাঁড়িয়ে সত্যকে দেখতে পাওয়ার কারণ বুঝতে পারলাম।

শোনা যায়, সরকার ও দলীয় বড় বড় নেতার ছেলেমেয়েদের অধিকাংশ বিদেশে লেখাপড়া করে। তাই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রসাতলে গেলেও তা তাদের ছুঁয়ে যায় না। তারা চান রাজনৈতিক লভ্যাংশ ঘরে তুলতে। তাই সত্য সমালোচনাও সহ্য করতে পারেন না। এই কু-আদর্শ চলছে দীর্ঘদিন ধরে। বিএনপি শাসনামলে একই ধারার সমালোচনা করে লিখেছি অনেক। তখন আওয়ামী লীগের দালাল বলে নিন্দিত হয়েছিলাম। আমার সাংবাদিক বন্ধু অনেকদিন সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে না থাকায় কিছুটা মুক্তচিন্তায় কথা বলতে পারছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের অন্ধ নেতানেত্রীরা কেবল প্রশংসা চান। এতে লাভের চেয়ে যে ক্ষতি বেশি হয়, তা বুঝতে পারেন না। আপনাদের লেখাগুলো বরং তাদের পথ চলতে সাহায্য করে। আপনারা সম্মানি ছাড়া পরামর্শকের কাজ করছেন, এটি বোঝা উচিত।’

সবকিছুতে দলীয়করণের ফর্মুলা থাকায় তা রাজনৈতিক চেতনার বন্ধুকে শত্রু বানিয়ে দিচ্ছে। আমার এক ছাত্র সরকারি কলেজের শিক্ষক। ডেপুটেশনে অনেকদিন শিক্ষাসংক্রান্ত একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। আমিও একসময় স্কুলপর্যায়ের কারিকুলাম তৈরি ও পুস্তক রচনায় কমিটির সদস্য হিসাবে কাজ করেছি।

বিএনপি আমলের ইতিহাস বিকৃতির অনেক জায়গা সংস্কার করার সুযোগ হয়েছিল আমার। একসময় আওয়ামী লীগ ধারার বলে পরিচিত প্রভাবশালী শিক্ষক-গবেষক ইতিহাসকে নিজ বা দলীয় লক্ষ্য পূরণের মতো করে লেখায় আমি অন্তরায় হয়ে উঠি। ইতিহাসের স্বাভাবিক সত্যকে পাঠ রচনায় রাখতে আমি অনড় থাকি। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে সহমত পোষণ করা আমরা কয়েকজন অব্যাহতি নিয়ে বেরিয়ে আসি। আর ওমুখো হইনি। আমাদেরও ডাকেনি। অনেক কাল পরে আমার ছাত্র জানাল, আমাকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য আমার গায়ে বিএনপি-জামায়াতের রং লাগানোর সক্রিয় চেষ্টা ছিল। এ ধরনের নিচু মানসিকতা পরেও অনেকবার দেখেছি।

এমন তিক্ত অভিজ্ঞতা অনেকেরই আছে। রাজনীতিতে এগিয়ে থাকার জন্য, প্রমোশনে সুবিধা পাওয়া জন্য অনেককে জামায়াত-বিএনপি ঘরানা বলে চিত্রিত করার চেষ্টা অনেক পুরোনো। এ ধরনের খড়্গ রাজনীতিনিরপেক্ষ মানুষের ওপর আঘাত হানে বেশি। অথচ নিজ দলে, দলীয় অঙ্গসংগঠনগুলোয় অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে অহরহ ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায় দলীয় নেতাদের।

আমরা জানি না কঠিন দলীয়করণে নিজেদের আলাদা করে ফেলার কতটুকু লভ্যাংশ ঘরে তোলা যায়। দলের সাইনবোর্ড উঁচিয়ে ধরা আর দলের আদর্শ ধারণ করা এক ব্যাপার নয়। আওয়ামী লীগ নেতাদের সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা হয়-ছাত্রলীগ-যুবলীগের কজন নেতাকর্মী আছেন, যারা দলীয় আদর্শ সম্পর্কে ধারণা রাখেন এবং সেই আদর্শমতো চলার চেষ্টা করেন? বঙ্গবন্ধুর আদর্শ কতজন অনুসরণ করেন? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তাদের কতটুকু চৈতন্য দিয়েছে?

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করতে পারে একমাত্র দেশপ্রেমিক মানুষ। আর বর্তমান রাজনৈতিক দিক বিচারে তারা মনের দিক থেকে আওয়ামী লীগ বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের মধ্য থেকে তেমন দূরদর্শিতা দেখা যায়নি। তারা দলের ভেতরের আবর্জনা সরাতে এ ধরনের মানুষদের গুরুত্ব অনুভব করতে পারেননি। অথবা তাদের আস্থায় রাখার কোনো চেষ্টা করেননি। সোজা কথায় বলা যায়, কঠিন দলতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ বন্ধু বাড়াতে পারেনি। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় কারও কারও মধ্যে সৃষ্ট আত্ম-অহংকারও প্রকাশ্যে লক্ষ করা যায়।

বর্তমান বৈশ্বিক ও জাতীয় সংকট সামাল দেওয়ার জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছে সরকার, এ বিষয়ে সুস্থ বিচার-বুদ্ধির মানুষের কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু পরিশ্রমের ফসল ঘরে তোলা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আমাদের বিচারে কঠিন দলতন্ত্র এর অন্যতম কারণ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতির বাড়বাড়ন্ত। দুর্নীতির বিষবাষ্পের কারণে অনেক মন্ত্রণালয় তাদের অদক্ষতা এড়াতে পারছে না। বড় দাগের আয়বৈষম্য একটি সরকারকে দ্রুত অজনপ্রিয় করে তোলে। আমাদের সরকারগুলো আয়বৈষম্য কমানোর জন্য প্রকৃত অর্থে তেমন ভূমিকা রাখেনি।

বরং দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন ও রাজনীতির কারণে আয়বৈষম্যই কেবল বেড়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অক্লান্ত পরিশ্রম ও আগ্রহে দেশের অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। মেট্রোরেল বাস্তবের দ্বারপ্রান্তে। কিন্তু এসব সাফল্য নির্বাচনের মাঠে বড় প্রভাব ফেলতে পারবে বলে মনে হয় না। এর বড় কারণগুলোর একটি কঠিন দলীয়করণের পথে হাঁটা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করা বহু মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। চলমান কাঠামোতে আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। দুর্নীতি কমিয়ে না আনতে পারলে সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেওয়া যাবে না।

এ দেশে বহু মানুষ আছে, যারা খেটে খাওয়া শ্রমজীবী। যারা দুমুঠো খাবারের জন্য জীবনযুদ্ধ করে। তারা দেশের উন্নয়ন বলতে বোঝে সহজে খেতে পারা আর নিশ্চিন্তে ঘুমানো। কিন্তু দলীয়করণের চাপে সব শ্রেণির মানুষকে যদি কোণঠাসা করে ফেলা হয়, তাহলে নির্বাচনের মতো সংকটে তাদের আস্থায় আনা যাবে কেমন করে? তাই আমরা মনে করি, দলীয় বৃত্তে সৃষ্টি করা অচলায়তন থেকে এখনই ক্ষমতাসীন দলের বেরিয়ে আসা উচিত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করা আর কোনো রাজনৈতিক পক্ষ দেশে নেই। এমন বাস্তবতায় মুক্ত বিবেকের মানুষ তাহলে যাবে কোথায়!

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

Pin It on Pinterest

Shares
Share This

Share This

Share this post with your friends!

Share This

Share this post with your friends!