সবিনয়ে জানতে চাই জানাতেও চাই

by | Jan 4, 2023 | আমার লেখা | 0 comments

১৫ অক্টোবর ২০১৯, দৈনিক যুগান্তর

আমরা যারা ইতিহাস থেকে সত্য ধারণ করতে চাই, মুক্তিযুদ্ধের মহান স্মৃতি যাদের বুকের ফটোপ্লেটে এখনও উজ্জ্বল, দলপ্রেম নয়, দেশপ্রেম যাদের ধমনিতে, সুবিধাবাদ যাদের আকর্ষণ করতে পারেনি, তারা দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে কলুষমুক্ত দেখতে চায়।

আওয়ামী লীগ সরকারের দক্ষতায় দেশের অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উন্নয়ন তাদের আমোদিত করে। তারা দেখতে পান তেমন কোনো রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ ছাড়াই আওয়ামী লীগ সরকারের লক্ষ্যপূরণের সুযোগ রয়েছে।

তবে শঙ্কা সুশাসনের অভাব এবং রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্বৃত্তায়ন সব অর্জনকে না নড়বড়ে করে দেয়। দূরদর্শী আওয়ামী লীগপ্রধান ও সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা তা বুঝতে পেরেছেন। তাই অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে নিজ ঘর থেকেই শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছেন।

কিন্তু এ সরকারের শুভার্থী হিসেবে আমাদের ভেতর কিছু শঙ্কার কালো মেঘ জমাট বাঁধছে। বারবার আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ও সরকারের পরিচালকরা দলীয় বৃত্তে আটকে গিয়ে মুদ্রার দুটো পিঠই কি দেখতে পাচ্ছেন? কারণ চারপাশে নানা পেশাজীবী ধামাধরা চাটুকারের সংখ্যা বাড়ছে। প্রকৃত সংকট তারা সরকারপ্রধানের দৃষ্টি থেকে সরিয়ে রাখতে চায়।

অন্যদিকে ক্ষমতা ও শক্তির মোহে নানা খানাখন্দ কি দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছে? পাহাড়ে ওঠা কঠিন- তবে স্বস্তি, এই কাঠিন্য অনেকটাই জয় করতে পারছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার দৃঢ় নেতৃত্বে। কিন্তু মুহূর্তের ভুলে বা বিভ্রান্তিতে পতন কিন্তু এক লহমায় হয়ে যেতে পারে। আমার এক স্কুলশিক্ষক বলতেন, আত্মম্ভরিতা মানুষকে অন্ধ করে দেয়।

বুয়েটের ছাত্র আবরারের হত্যা মর্মান্তিক। কিন্তু এমন হত্যাকাণ্ড এ দেশে নতুন নয়। যখন থেকে ছাত্র রাজনীতি অঙ্গ বা সহযোগী যে নামেই হোক মূল দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তখন থেকে ক্যাম্পাসে রাজনীতির শক্তিতে খুনোখুনির যাত্রা শুরু হয়েছে।

একসময় তো ছাত্র শিবিরের রগ কাটা রাজনীতির বিভীষিকা ছড়িয়ে পড়েছিল, বিশেষ করে রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই দলটি জামায়াতে ইসলামের অঙ্গ। ওদের রগ কাটা ইমেজ বেশ মানিয়ে গিয়েছিল। কারণ মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতের হিংস্র চেহারা আমরা ভুলতে পারি না। সুতরাং এই দলটির অঙ্গ তো আর ভিন্ন আচরণ করবে না।

অন্যদিকে রাজনীতিকে ‘ডিফিকাল্ট’ করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েই তো জিয়াউর রহমান রাজনীতি ও সরকার পরিচালনা করেছিলেন। অস্ত্র আর অর্থ তুলে দিয়েই তো ছাত্রদলের যাত্রা শুরু করিয়েছিলেন তিনি। সে সময়েও তো খুনোখুনি কম হয়নি। আর এই দলের বাইপ্রডাক্টই তো ছিল এরশাদের ছাত্রসমাজ। তাই অস্ত্রচর্চা এরাই বা কম করবে কেন?

মানুষ সুন্দরের স্বপ্ন বুনতেই পছন্দ করে। আশা নিয়েই মানুষের বাঁচা। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর মানুষ কিছুটা শুভ প্রত্যাশা করেছিল। ভেবেছিল ঐতিহ্যবাহী দল ছাত্রলীগ। যার বয়স আওয়ামী লীগের চেয়েও বেশি। নানা গৌরবময় আন্দোলন-সংগ্রামে যুক্ত থেকে নিজের উজ্জ্বল ঐতিহ্য গড়েছে দলটি।

সেই গৌরবের ছাত্রলীগে বেড়ে ওঠা আজকের আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতারা দলে ও সরকারে থেকে একটি শোভন ছাত্র রাজনীতির দীক্ষা দেবেন, এটিই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, এ যুগে এসে ছাত্রলীগকে সেই মার্জিত রূপে আমরা দেখতে পাইনি। ছাত্র রাজনীতি ষণ্ডাতন্ত্রে আটকে যাওয়ায় ক্যাম্পাসে মেধাবীরা রাজনীতিবিমুখ হয়েছে।

অর্থশক্তি আর পেশিশক্তির মোহে ছাত্র রাজনীতির ক্ষমতাসীন তরুণরা আসক্ত হয়ে পড়েছে। সুস্থ রাজনীতি চর্চা না থাকায় কখনও শাসন ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আবার কখনও শাসন ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ছাত্রলীগে নাম লেখানো তরুণদের দলের লাঠিয়াল বানানো হয়েছে। এর পরিণতি শেষ পর্যন্ত ভালো হতে পারে না।

আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের একটি সমস্যা আমি দেখতে পাই। তারা দেশের মানুষকে বোকা ভাবতে পছন্দ করেন। তাই এমন সব কথা বলেন তা আসলে সচেতন মানুষকে বিরক্তই করে। এই যেমন আবরার হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগ নেতাদের কণ্ঠে শুনি- এটি নাকি বিচ্ছিন্ন ঘটনা।

তাই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর দায় ছাত্রলীগ নেবে না। এই ছেলেদেরও দুর্ভাগ্য, আওয়ামী লীগ এখন নিজ ঘর ঠিক রাখতে চায়। তাই অপকর্মের জন্য এরা বলী হলেও নেতৃত্বের কিছু যায়-আসে না।

তাই এদের গ্রেফতার করিয়ে আদালতের হাতে দিয়ে নিরপেক্ষতার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ তৈরি করতে পারবে! কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে সব ক্যাম্পাসেই যে ছাত্রলীগ বখাটে হয়ে গেছে এই সত্য তো তারা স্বীকার করতে চাইছেন না। এখানেই আমাদের আশঙ্কার জায়গা।

এই যে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে সাধারণ ছাত্রদের ছাত্রলীগ এক রকম জিম্মি করে রেখেছে তা কি কেন্দ্রীয় নেতারা জানেন না? মিছিলে না গেলে, ছাত্রলীগের বড় ভাইদের আদেশ না শুনলে বা ভিন্ন মত প্রকাশ করলে তাদের গেস্টরুমে বা তথাকথিত টর্চার সেলে নিপীড়ন করা হয়।

যেখানে হল প্রশাসন প্রায়ই প্রতিবিধান না করে অক্ষমতা প্রকাশ করে এ কথা কি কারও অজানা? নেতারা উচ্চাসনে বসার কারণে যদি না-ই দেখতে পান, তবে এতসব গোয়েন্দা সংস্থা কী রিপোর্ট দেয়। নাকি দাপট দেখিয়ে চলার মধ্যেই বীরত্ব দেখছেন। বাহ্বা দিচ্ছেন!

আওয়াজটা যদিও পুরনো, আবার বুয়েট থেকে নতুন করে শুরু হয়েছে, ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হোক। যে কোনো সচেতন মানুষ ও ভুক্তভোগী বলবেন দলীয়বৃত্তে বন্দি ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি সব শাসনযুগে ক্ষমতাসীনদের উপকারে লাগলেও শিক্ষার স্বাভাবিক ও কাঠামোগত উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে।

এতে সাধারণ্যে অস্বস্তি যেমন তৈরি হচ্ছে ক্ষোভও বাড়ছে তেমনি। এতে দল ও দলীয় সরকার অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একটি খুব অদ্ভুত কথা সুবিধার স্রোতেভাসা রাজনীতিকরা বলেন- ছাত্র রাজনীতি না করলে নাকি রাজনীতির ট্রেনিং পাওয়া যায় না। তাই ছাত্র রাজনীতি না থাকলে ভবিষ্যৎ রাজনীতির হাল ধরবে কারা!

তাহলে রাজনীতির প্রশিক্ষণ পাওয়া যে ছাত্রলীগের পরিচয় আমরা পাচ্ছি তাতে ভবিষ্যৎ রাজনীতির হাল ধরে এরা খুনির পৃষ্ঠপোষকতা করবে, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি আর কমিশন বণিকদের আশ্রয়দাতা হবে। দুর্নীতি আর সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য হয়ে যাবে দেশ।

সভ্য দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ইউনিয়ন থাকে। তারা শিক্ষার্থীদের ভালো-মন্দ দেখে। একাডেমিক উন্নয়ন ও সংস্কৃতি বিকাশে ভূমিকা রাখে। জাতীয় রাজনৈতিক দলের সহযোগী বা অঙ্গ-সংগঠন হিসেবে চলা তারা বোঝে না। শিক্ষকরা হন শিক্ষা গবেষণায় নিবেদিতপ্রাণ। রাজনৈতিক দলাদলির অভিজ্ঞতা তাদের নেই।

তাই বলে কি রাজনৈতিক সচেতনতা তাদের মধ্যে তৈরি হয় না? জাতির প্রয়োজনে তারা মাঠে নামেন না? আইরিশ আন্দোলন এবং ফ্রান্সের সংকটে কি ছাত্র-শিক্ষকরা নিশ্চুপ বসেছিলেন?

আমাদের দেশে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ এবং অতঃপর জাতির সংকটে সাধারণ ছাত্র, শিক্ষক, পেশাজীবী সবাই কি ঝাঁপিয়ে পড়েননি? বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী- যার রাজনীতির প্রতি ঝোঁক আছে- পড়াশোনা আছে তারা রাজনীতির মাঠে তথাকথিত প্রশিক্ষণ পাওয়াদের চেয়ে অনেকটা এগিয়ে থাকে।

এটি ঠিক, একটি সাংগঠনিক শক্তি সুচারুভাবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ছাত্র রাজনীতি বা শিক্ষক রাজনীতি নয়, ছাত্রের রাজনীতি ও শিক্ষকের রাজনীতির জন্য বিভিন্ন আদর্শের সংগঠন থাকতেই পারে। তবে তা হতে হবে যে কোনো রাজনৈতিক দলের সংশ্রবমুক্ত। সরকারি দলআশ্রিত ছাত্রসংগঠন এতটা হিংস্র, এতটা উন্মত্ত হয় কেন?

কারণ এসব সংগঠনের ছাত্রদের মাথার ওপরে থাকে তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের আশীর্বাদের ছাতা। এভাবে তারা শক্তিমান হয়। অর্থশালী হয়। পরিশেষে বখাটে হয়ে যায়। তাদের দাপটে অসহায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

এই তো সেদিন টেলিভিশনের পর্দায় দেখলাম বুয়েটের ছাত্রকল্যাণ পরিচালক বলছিলেন তাদের কথায় পুলিশ আসে না, আসে বা চলে যায় ছাত্রলীগের নেতাদের কথায়। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে- হল প্রশাসনের সঙ্গে যারা যুক্ত আছেন তারা এ সত্যটিই দেখে আসছেন।

সুতরাং এমন কাঠামোয় যে সাংগঠনিক ছাত্র রাজনীতি দাঁড়িয়ে আছে একে বহাল রেখে কোনো কল্যাণ হবে না। আমি আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে দ্বিধাহীনভাবে বলতে চাই, ক্যাম্পাসে যদি রাজনৈতিক দলআশ্রিত ছাত্র রাজনীতি না থাকে এবং দলীয় শিক্ষক রাজনীতি বিলুপ্ত হয় তবে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই শিক্ষার পঞ্চাশ ভাগ মানোন্নয়ন দেখতে পাব। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের সুবিধাবাদী রাজনৈতিক নেতৃত্ব এ পথে হাঁটবেন কিনা।

গত শতকের আশির দশকেও এমন দশা ছিল না। তখন রাজনৈতিক হানাহানি ক্যাম্পাসে যে ছিল না তেমন নয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বাম দলগুলো তখনও শক্তিশালী ছিল না অন্য কোথাও। সত্তরের দশকের শেষদিকে ছাত্রলীগ মুজিববাদী আর জাসদে ভাগ হয়ে অনেক রক্ত ঝরিয়েছে।

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তরুণদের হাতে অস্ত্র আর অর্থ দিয়ে সন্ত্রাসী বানিয়েছিলেন। তবুও এদের মধ্যে সামান্যতম ন্যায়বোধ ছিল। মারামারি লাগলে ভিন্ন আদর্শের হলেও নিজ বিভাগের ছাত্রদের রক্ষায় এগিয়ে আসত। এখন তো ক্ষমতার দাপটে একজন ছাত্রলীগ নেতা বা কর্মী দু’বছরের সিনিয়র ভাইকেও চড় মারতে দ্বিধা করেন না।

আর অপমানিত সিনিয়র মাথা নিচু করে চলে যান। জানে এর প্রতিবিধান কেউ করবে না। হল প্রশাসনের শিক্ষকরা র‌্যাগিং বন্ধ করতে পারেন না। জেনেও ছাত্রলীগের টর্চার সেল বা গেস্টরুমে ওদের আদালত থেকে অত্যাচারিত সাধারণ ছাত্রদের রক্ষা করতে পারেন না। এসব অপসংস্কৃতি যদি বন্ধ না হয়, তবে বিশ্ববিদ্যালয় তার সৌন্দর্য ফিরে পাবে না।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি, প্রোভিসি বা ট্রেজারার নিয়োগে যদি দল আনুগত্যের বিচারে গিয়ে পাণ্ডিত্যের বিচার করা না হয়, স্খলন চলতেই থাকবে। একজন সুশিক্ষিত দৃঢ়চেতা দলনিরপেক্ষ ভিসি আপন যোগ্যতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক নেতৃত্ব যেমন দিতে পারেন তেমনি দক্ষ প্রশাসকের ভূমিকায়ও সফল হন।

নানা তদবিরে আসা দুর্বল ভিসিদের দশা তো আমরা দেখছিই। বিদগ্ধ পণ্ডিত জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী স্যারের মতো ভিসিরা ব্যর্থ হননি। কারও দয়া-দাক্ষিণ্যের পেছনে তাদের ছুটতে হয়নি। এখন প্রতিষ্ঠানটি এমনভাবে ভেঙে ফেলা হয়েছে, ভিসির দায়িত্ব নেয়ার জন্য এসময়ের একজন জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীকে রাজি করানো কঠিন হবে।

রাষ্ট্র ও সরকারের ভেতর যদি এমন ভাবনা আসে যে, বিশ্ববিদ্যালয়কে জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান সৃষ্টির তপোবন তৈরি করবেন, তবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের চিন্তা বাদ দিয়ে সবকিছু নতুনভাবে সাজাতে হবে।

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

Pin It on Pinterest

Shares
Share This

Share This

Share this post with your friends!

Share This

Share this post with your friends!