১৫ মার্চ ২০২২, দৈনিক যুগান্তর
৮ মার্চ ছিল আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এভাবে দিবস পালন অনেকের কাছে অর্থহীন; আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমি মনে করি, এভাবে বছরে একদিন অন্তত আমরা চৈতন্যে ফিরতে পারি। নতুন করে ভাবনার অবকাশ তৈরি হতে পারে। বৈশ্বিকভাবে এবং বাংলাদেশেও নারীর অগ্রগতি অনেকটা সাধিত হয়েছে। আরও এগিয়ে চলার জন্য এর মূল্যায়নের যেমন গুরুত্ব রয়েছে, আবার সমাজে এখনো নারীর সামনে প্রতিবন্ধকতার বাস্তবতাও কম নয়। নারী দিবসে এসব সত্য সামনে নিয়ে আসার সুযোগ থাকে। তাতে সার্বিক কল্যাণ সাধনের একটি সুযোগও তৈরি হতে পারে।
কোনো কোনো নারীবাদী লেখক ও গবেষকের চিন্তায় যখন ফর্মুলাবদ্ধ চেতনার প্রকাশ দেখি তখন শঙ্কা হয়, সত্যিই কি নারীকে এগিয়ে দিতে তারা সাহায্য করছেন? আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা একজন সহকর্মী নারী দিবসের দুদিন আগে আমাকে এ দিবস উপলক্ষ্যে প্রশাসনের আয়োজনে করা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখার জন্য অনুরোধ জানালেন। আমি অবশ্য প্রশাসনের আয়োজনে যে কোনো অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলতে পছন্দ করি। এর বড় কারণ সম্ভবত আমি বর্তমান ধারার শিক্ষক রাজনীতি পছন্দ করি না বলে। আমাদের চলমান বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতিতে দলীয় রাজনীতি বিচ্ছিন্ন শিক্ষক প্রশাসনের কাছে মূল্যহীন। দলীয় রাজনীতিতে বিরোধী পক্ষ হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের মূল্য থাকে। আমি অবশ্য মূল্য-অমূল্য নিয়ে ভাবি না। কিন্তু এসব অনুষ্ঠানে গেলে তোষামুদে বক্তব্য অনেক্ষণ চলতে থাকে বলে আমার অস্বস্তি হয়-অযথা সময় নষ্ট হচ্ছে বলেও মনে হয়। তাই প্রশাসন আয়োজিত অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলতে চাই।
অনুষ্ঠানে অনেক নারী সহকর্মী চমৎকার শব্দ চয়নে বক্তৃতা করলেন। তারা বললেন নারীর অগ্রগতির কথা। পরীক্ষার ফলাফলে আজকাল মেয়েরা এগিয়ে থাকছে। পেশা জীবনেও তারা অনেকটা সফল। তবুও সমাজ জীবনে নারীদের প্রতিবন্ধকতা অনেকটা রয়েছে। আছে বাল্যবিবাহের অভিশাপ। এসবই রূঢ় সত্য। তবে একটি বিষয় আমাকে ভাবিয়ে তুলল। তা হচ্ছে, অনেকের মধ্যেই গতানুগতিক শব্দ চয়ন। অর্থাৎ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ইত্যাদি। দেশের আজ গুরুত্বপূর্ণ অনেক জায়গায় নারীদের অবস্থান। বক্তা নারীরাও এখন যার যার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত। তবে তারা নারী অধিকারের প্রশ্নে সমাজ পরিবর্তনে পুরুষকে প্রতিবন্ধক মনে করে যাচ্ছেন কেন! তাদের সব ক্ষেত্রে অবস্থান-ক্ষমতা থাকার পরও পুরুষ মুখাপেক্ষী থাকার কারণ থাকতে পারে না। এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্যের সুর ধরে নারী-পুরুষের সম্মিলনে একটি শান্তির সুবাতাস বইয়ে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু অদ্যাবধি আমরা সেভাবে কথা বলতে পারছি না।
আমার মাঝেমধ্যে জানতে ইচ্ছা হয়, একজন শিক্ষিত সচেতন নারী নিজের পরিবার ও ঘনিষ্ঠ সমাজ থেকে নারী (কখনো কখনো পুরুষের প্রতি) সহিংসতা হ্রাসে কতটা কাজ করছেন। গত এক সপ্তাহে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া দুই ছাত্রী প্রায় একই ধরনের কষ্টের কথা জানাল। একটি মেয়ে মধ্যবিত্ত পরিবারের। বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় সেমিস্টারে পড়ার সময় বিয়ে হয়ে গেছে। যদিও অনলাইনে ক্লাস হচ্ছিল, তবুও মেয়েটি ক্লাসে অনিয়মিত। মাঝে মধ্যে কুইজ পরীক্ষা দিতে পারছে না। ফাইনাল পরীক্ষা সামনে। শিগ্গির ভার্চুয়াল জগৎ থেকে বেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সরাসরি ক্লাস করতে হবে এবং পরীক্ষা দিতে হবে। এবার বিপদে পড়েছে মেয়েটি। শাশুড়ি চান না মেয়েটি লেখাপড়া চালিয়ে যাক। অসুস্থ শ্বশুরের সেবা করার জন্যই নাকি তাকে বউ করে আনা হয়েছে। ননদও মায়ের পক্ষে। বড় জা মেয়েটিকে সাহায্য করতে চায়, কিন্তু শাশুড়ি ও ননদের ভয়ে পারে না। ভাসুর ও বর মেয়েটিকে সাহায্য করতে চাইলেও কুলিয়ে উঠতে পারে না। অসুস্থ শ্বশুর-শাশুড়িকে বোঝাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন।
দ্বিতীয় ছাত্রীটির অবস্থাও প্রায় একই রকম। মেয়েটি ধনী পরিবারের। শ্বশুরও অর্থশালী। ওরা ভালোবেসে বিয়ে করেছে, একইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। বেকার অবস্থায় স্বামীর কণ্ঠ সবল থাকে না। শ্বশুরবাড়ি ঢাকার বাইরে। ওর স্বামীরা এক ভাই চার বোন। মা আর বোনদের নিয়ন্ত্রণে সংসার। শ্বশুর নির্বিবাদী মানুষ। স্ত্রীর কথার বাইরে প্রতিবাদ করার ভাষা তার নেই। শাশুড়ি ও তার মেয়েরা চায় না বউ লেখাপড়া করুক। সংসারে এক ধরনের মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে মেয়েটি। আয়-রোজগারহীন শিক্ষার্থী স্বামীর ব্যক্তিত্ব দুর্বল হয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন, মেয়েটির পাশে এখন আর ছায়া হয়ে দাঁড়াচ্ছে না সে। দিনে দিনে স্বামীও ওর প্রতি বৈরী হয়ে উঠছে। মেয়েটি এখন অনেকটা দিশেহারা। ভালোবেসে বিয়ে করায় আমাদের সমাজ বাস্তবতার কারণে সব কথা নিজ পরিবারেও বলতে পারছে না।
আমার এক পরিচিত মনোবিজ্ঞানী বোন বলছিলেন, এদেশে বেশিরভাগ পরিবারের বউরা মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয় পরিবারের মহিলাদের কাছ থেকেই। এ সত্য মেনে নারী দিবসের নারী বক্তাদের বিশেষ করে বলতে ইচ্ছা করে, আসুন বক্তৃতার মঞ্চ মুখরিত না করে আমরা সবাই চেষ্টা করি যার যার বৃহত্তর পরিবারকে সংস্কারের আলোতে আনতে। সাংসারিক জীবনে শাশুড়ি-বউ অথবা বউ-শাশুড়ি, মা-মেয়ে বা মেয়ে-মা হয়ে যেতে পারে কিনা। দেবর-ননদ-ভাবি সবাই মানসিকভাবে ভাইবোন হয়ে যেতে পারি কিনা। শ্বশুর-বউ, বাবা-মেয়ের নৈকট্যে আসতে পারি কিনা। আমার কথাসাহিত্যিক বোন তার তিন বৌমার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। তিনি ওদের বৌমা বলেন না, বলেন ‘বৌমেয়ে’। শব্দটি আমি খুব উপভোগ করি।
নারীদের অনেকে এখন নিজ মেধার গুণে পেশা জীবনের উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। তারপরও কর্মক্ষেত্রে অনেক সময় নারীর প্রতি সহিংসতার কথা শোনা যায়-লাঞ্ছনার কথা শোনা যায়। এসব প্রতিরোধে সবার ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু বিষয়গুলো নিয়ে সচেতন নারী-পুরুষ সমাজে খুব যে আওয়াজ তুলছেন তেমন শোনা যাচ্ছে না। আমার ধারণা যদি বাস্তব সত্য অনুধাবন করা না যায়, তবে বিভ্রান্তির পথে হাঁটতে হবে। প্রায় আট-দশ বছর আগের একটি ঘটনা মনে পড়ল। ঢাকায় একটি সংগঠন আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল বিশ্বসভ্যতা নিয়ে ওদের পাঠচক্রে ধারাবাহিক আলোচনা করার জন্য। এমনই এক আলোচনা অনুষ্ঠানে এসেছিলেন একজন নারীবাদী গবেষক হিসাবে পরিচিত অধ্যাপক। তার গবেষণা অঞ্চল ১৯ ও ২০ শতকের বাংলার নারী। তিনি তার আলাপচারিতায় বলছিলেন, সমাজে নারী অধিকার ভূলুণ্ঠিত করে আমরা মধ্যযুগের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
আমাদের সমাজে শিক্ষিত, স্বল্প-শিক্ষিত অনেকের মধ্যেই প্রবণতা রয়েছে বাংলার ইতিহাসের মধ্যযুগ অধ্যয়ন না করে মধ্যযুগকে বর্বর যুগ বলে আখ্যায়িত করা। আমি বিনয়ের সঙ্গে শ্রদ্ধেয়াকে বলেছিলাম, মধ্যযুগে নারী অধিকারের অগ্রগতি ছিল। পাঠশালাগুলোতে চালু ছিল সহশিক্ষা। তিনি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। আমি বললাম, মধ্যযুগের সাহিত্য ও প্রত্ননিদর্শনে এর অনেক প্রমাণ রয়েছে। ষোল শতকের চট্টগ্রামের কবি দৌলত উযির বাহরাম খাঁ তার লাইলি-মজনু কাব্যে এটি পাঠশালার চিত্র অঙ্কনে লিখেছিলেন, ‘সুন্দর বালকগণ অতি সুচরিত/একস্থানে সভানে পড়য় আনন্দিত/সেই পাঠশালায় পড়ে কত বালা/সুচরিত সুললিত নির্মল উজ্জ্বলা।’ আবার পনের শতকের মাঝামাঝি ঢাকার নারিন্দার মুসলিম বসতিতে সমাজকর্মে এগিয়ে এসেছিলেন একজন নারী। তিনি একটি মসজিদ নির্মাণ করে দিয়ে শিলালিপিতে নিজের নাম উৎকীর্ণ করেছিলেন ‘মোসামাৎ বখত বিনত’। এখনো নারিন্দা মসজিদের গায়ে ফার্সি শিলালিপিটি রয়েছে। একই শতকে গৌড়ে নির্মিত একটি সুলতানি মসজিদে অজুখানা নির্মাণ করে দিয়েছিলেন একজন নারী। শিলালিপিতে নিজের নাম লিখেছেন ‘বিবি মালতি’। নামে বোঝা যায় তিনি ধর্মান্তরিত মুসলিম। তারপরও তিনি পূর্ব সমাজের ‘মালতি’ নামটি ধারণ করতে পেরেছিলেন। নারীরা অনেকটা পিছিয়ে পড়তে থাকে গোঁড়া কট্টরবাদী সামাজিক বিধিনিষেধের আবরণে-সতিদাহ প্রথা, বাল্যবিবাহ প্রচলন আর বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধের মধ্য দিয়ে। যে কারণে উনিশ শতকে সমাজ সংস্কারে এগিয়ে এসেছিলেন রাজা রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। মধ্যযুগের শুরু থেকে প্রত্যেক মুসলমান পরিবারের ছেলেমেয়েদের জন্য প্রাথমিক পাঠ বাধ্যতামূলক ছিল। সন্তানের বয়স চার বছর চার মাস আর চারদিন হলে মিষ্টি মুখ করিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পাঠ দেওয়ার রীতি ছিল। এর নাম ছিল ‘বিসমিল্লাহখানি’ অনুষ্ঠান। এর ধারাবাহিকতাতেই হিন্দু সমাজে হাতেখড়ি অনুষ্ঠানের প্রচলন হয়।
ইতিহাসের এসব পাঠ থেকে শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। আমাদের দেশের মেয়েদের ঘুরে দাঁড়ানোর পথ যারা দেখাতে চান, তাদের গৎবাঁধা হা-হুতাশ না করে ঐতিহ্যের কাছ থেকে প্রেরণা নিতে হবে। নারীর হাতে, গলায় গহনা তুলে দিয়ে পুরুষ এক রকম নারীকে শেকল বন্দি করে ফেলেছে অথবা স্বামীর নাম নিজের নামের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে নারীর স্বাতন্ত্র্য নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে-এমন ধারার কট্টর চিন্তা অযথা নারী-পুরুষের মধ্যে দূরত্বই বৃদ্ধি করে। সেই পাথর যুগে শিকারি নারী দৈহিক শক্তিমত্তার বিচারে পুরুষ নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিল। অন্য পুরুষ সদস্যরাও নেতার সামনেই নতজানু হয়েছে। কিন্তু এ নারীই সন্তানসম্ভবা হলে এক পর্যায়ে শিকারে যেতে পারেনি। গুহায় বসে বসে অলস সময় কাটাতে গিয়ে নিজস্ব পর্যবেক্ষণে কৃষি আবিষ্কার করে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেছে। এতে দলবদ্ধ সমাজে তার সম্মান কতটুক বেড়েছিল বা বাড়েনি তার ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। কিন্তু বর্তমানে জ্ঞান বুদ্ধি ও অর্জনে নারী নিজের অবস্থান ও পরিচিতি তৈরি করেছে। এক্ষেত্রে কর্মজীবী নারী ও পুরুষ এক পরিবারে কতটুকু সুবিধাভোগী বা বঞ্চিত এ ভাবনা-সমালোচনা বৃথা। সংসারে নিজেদের ভালোলাগা-মন্দলাগা নিয়েই সাজিয়ে নেন উভয়ে। এতে বিভেদ তৈরি করার জীবাণু ঢোকানো অপপ্রয়াস মাত্র। এ ক্ষেত্রে কখনো পুরুষ বা নারীর যার যার অবস্থান থেকে অভিযোগ পালটা অভিযোগ থাকতে পারে। এসব সরলীকরণের কোনো মানে হয় না। সমাজ অগ্রগতির ধারায় অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়-হয়ে আসছে। নারী মুক্তির অগ্রদূত রোকেয়া অবলীলায় স্বামীর নামের অংশ শাখাওয়াত হোসেন যুক্ত করে রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন নামেই নিজেকে পরিচিত করিয়েছিলেন। প্রসঙ্গক্রমে তিনি লিখেছেন তার ‘রোকেয়া’ হওয়ার পেছনে দুজন পুরুষের ভূমিকাই ছিল বেশি। একজন বড়ভাই ইবরাহিম সাবের আর অন্যজন স্বামী শাখাওয়াত হোসেন।
বাস্তবতা বিচারে অস্বস্তির দূরত্ব না বাড়িয়ে পুরুষ-নারী উভয়েই পারি সরল ব্যাখ্যায় সমাজে সুন্দর ফুল ফোটাতে; যেখানে কন্যা, জায়া আর জননীরা সুখে থাকে। পাশাপাশি পুত্র, স্বামী আর বাবারা যাতে সুখে থাকেন তেমন পরিবেশ আমাদেরই তৈরি করতে হবে। প্রত্যেক পরিবার এমন করে ভাবতে পারলে বছর ঘুরে দিবস পালনে অযথা আক্ষেপের জোয়ারে অস্বস্তি বাড়িয়ে অকল্যাণ ডেকে আনার প্রয়োজন পড়বে না।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়