১৮ মে ২০২২, দৈনিক যুগান্তর
ষোল শতক থেকে ইংল্যান্ড বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য বিস্তার শুরু করলেও আঠারো শতকে শিল্পবিপ্লবের পর উৎপাদিত পণ্যের বাজার দখলের জন্য ইংল্যান্ড বিশ্বের নানা অংশে নতুন উৎসাহে উপনিবেশ গড়ে তুলতে থাকে। আঠারো শতকের মাঝ পর্বে ব্রিটিশ সরকারের তেমন পরিকল্পনা ছিল না বাংলায়, তথা ভারতবর্ষে উপনিবেশ গড়ার।
এ যুগে বাংলার সম্পদের আকর্ষণে ইউরোপের নানা দেশের বণিকরা পূর্ব ভারতে অবস্থিত বাংলায় আসতে থাকে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে। সে কারণে সব দেশের কোম্পানির নামের আগে জুড়ে দেওয়া হয় ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’। যেমন ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, ফ্রেঞ্চ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, ডাচ্ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ইত্যাদি।
বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অনেকেই এক সময় পিছু হটে। টিকে থাকে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই কোম্পানি-ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ফ্রেঞ্চ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। মুর্শিদাবাদের নবাবদের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের সুযোগে পলাশীর যুদ্ধের পথ ধরে ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি টিকে যায়।
ঘটনাক্রমে বাংলার শাসন ক্ষমতাও এসে যায় এ বাণিজ্যিক কোম্পানির হাতে। এভাবেই ইংল্যান্ডের ঔপনিবেশিক শাসনের পত্তন ঘটে বাংলায়। আমরা অনেক সময় ভুল করে বললেও মানতে হবে, প্রথম একশ বছরের শাসন ব্রিটিশ শাসন নয়। বণিক প্রতিষ্ঠান ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের একটি ফর্মুলা ছিল। তারা উপনিবেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করবে। মানুষকে সুখে রেখে সরকারের অনুগত করে ফেলবে। আর সেই সুযোগে উপনিবেশের সম্পদ পাচার করে পূর্ণ করবে নিজ দেশ। এক সময় উপনিবেশের মানুষ জেগে উঠলে, প্রতিবাদ করলে অবশেষে সবকিছু গুটিয়ে ফিরে যাবে স্বদেশে। বণিক কোম্পানির হাত ধরে উপনিবেশ গড়ে উঠলে অনুমান করা হয়, সুশাসন প্রতিষ্ঠার পাঠ দিয়ে দেওয়া হয়েছিল বণিক ইংরেজ শাসকদের।
কিন্তু সে পরামর্শ বেশিদিন মাথায় রাখতে পারেনি বণিক-শাসকরা। বণিকের ধর্ম পুঁজি বাড়ান ও লভ্যাংশ কুক্ষিগত করা। তাই সৎপরামর্শ ভুলে লোভের মাত্রা বাড়াতে থাকে। এতে করে উপনিবেশের মানুষ অনুগত থাকার বদলে দিনে দিনে বিক্ষুব্ধ হতে থাকে। এরই শেষ বিস্ফোরণ ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লব। দেশীয় সিপাহিরা অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে গোরা সৈন্যদের ওপর। ব্রিটিশ শাসকদের কাছে এটি ছিল অকল্পনীয়। ইংল্যান্ডের প্রিভি কমিটি বুঝতে পারল বণিক কেবল লভ্যাংশ ও পুঁজির পেছনে ছুটে। ওদের দিয়ে উপনিবেশের শাসন পরিচালনা সম্ভব নয়। তাই রানী ভিক্টোরিয়ার আদেশে ভারতের কোম্পানি শাসনের অবসান ঘটিয়ে ব্রিটিশ শাসনের যাত্রা শুরু করা হয়। এভাবে শাসন ক্ষমতা হারিয়ে নিশ্চয়ই মনঃক্ষুণ্ন হয়েছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নেতারা।
গত ১১ মে রাতে টিভির খবর দেখতে গিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কথা মনে পড়ায় আজকের লেখার সূচনায় ধান ভানতে শিবের গীত গাইতে হলো। ভোজ্যতেল নিয়ে তো তেলেসমাতি কাণ্ড ঘটছিল রোজার আগে থেকেই। তারপর গৎবাঁধা নানা কারণ দেখিয়ে দফায় দ
ফায় মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে ব্যবসায়ীবান্ধব সরকার ব্যবসায়ীদের আর্থিক প্রণোদনা দিতে থাকে। আমরা তখন থেকে লিখছিলাম, বণিক স্বার্থ সাধারণ মানুষের স্বার্থ নিয়ে ভাববে না। তারা সরকারের কাছ থেকে নানা প্রণোদনা আদায় করে স্বমূর্তিতেই থাকবে। তারপরও দফায় দফায় ভোজ্যতেলের মূল্য কখনো ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট নিজগুণে বাড়াল, কখনো ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষক সরকারও ধাপে ধাপে মূল্য বাড়াল। ফলাফল ছোট শূন্য থেকে বড় শূন্য হলো। নতুন মূল্যবৃদ্ধির ফায়দা লোটার জন্য দেশজুড়ে কম দামের তেল বণিকরা মজুত করতে থাকল গোপন কুঠুরিতে। তেল সংকট তৈরি করল বাজারে। এসব নিয়ে অন্তত আমাদের মতো অতি সাধারণ কলাম লেখকরা আগে থেকেই সতর্ক করেছিলাম। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এসব জানার বা পড়ার অবকাশ কোথায়!
অনন্যোপায় হয়ে মাঠে নামে ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর। একে একে গোপন কুঠুরির সন্ধান মিলতে থাকে। হাজার হাজার লিটার তেল বেরিয়ে আসতে থাকে। এ অধিদপ্তর যদিও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা, তবুও থলের বেড়াল বেরিয়ে আসায় এবার বাণিজ্যমন্ত্রী মহোদয় মুখ খুলেন। নিজে বণিক হয়েও বণিক চরিত্র বুঝতে পারেননি। এখন হতাশ কণ্ঠে জানালেন এবার তিনি বুঝতে পারলেন ব্যবসায়ীদের কথায় বিশ্বাস করা তার ভুল ছিল। আমাদের তো ধারণা, নিজেদের নানা সংস্থা থাকার কারণে আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের বুঝতে পারার অনেক আগেই বুঝে যাবে সরকারযন্ত্র। সেভাবে ব্যবস্থা নেবে। এ দেশে ঘটছে উলটো। সাধারণ মানুষ বুঝতে পারার অনেক পরে বুঝতে পারেন ক্ষমতাবান বিধায়করা! এ কারণেই সম্ভবত আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে দেখতে পাই, যে কোনো সংকট ঘনীভূত হলে শেষ পর্যন্ত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেই সংকট সমাধান করতে হয়। এটি একটি দেশের জন্য হতাশার বৈকি!
কার্যকারণ সূত্রে মনে হচ্ছিল, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বণিক স্বার্থ রক্ষায়ই বেশি নজর রাখছে। এখন দেশের দর্শন জনগণের সামনে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ফিরিস্তি উন্মোচন করা। জিডিপি বাড়ছে, বাড়ছে মাথাপিছু আয়। শুনতে খুব আনন্দ হয়; কিন্তু প্রান্তিক মানুষ থেকে শুরু করে সাধারণ জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য অংশের মাথাপিছু আয়ের বড় অংশটিই যে চলে যাচ্ছে শক্তিমানদের ঝুলিতে-আয়-বৈষম্য যে দিন দিন প্রকট হচ্ছে, সে সত্যটি সরকারপক্ষ আড়াল করতে চাইছে।
এতে সাধারণ মানুষ অবকাঠামোগত নানা উন্নয়ন দেখে এবং অর্থনৈতিক শক্তিবৃদ্ধির কথা শুনে কতটা আনন্দিত হচ্ছে, আর কতটা হতাশ ও ক্ষুব্ধ হচ্ছে, সে সত্যটি নিয়ে সরকারের ভাবার অবকাশ আছে কিনা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। কেন যে তারা বুঝতে চাইছেন না যে, ঝড় একবার এসে গেলে তখন থামানো কঠিন হয়ে যাবে।
এবার ১১ মে রাতের টিভি খবরের কথায় আসি। যখন অসৎ ব্যবসায়ীদের মজুত করা তেল উদ্ধার করতে থাকল ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর, দায়ী ব্যবসায়ীদের জরিমানা করতে লাগল, কম দামে কেনা তেল সঠিক দামে বিক্রিতে বাধ্য করল, তখন ভেবেছিলাম ব্যবসায়ীদের সংগঠন লজ্জা প্রকাশ করবে। নিজেদের ব্যর্থতার জন্য ক্ষমা চাইবে। কারণ সাপুড়ে ভালো জানে সাপের গর্ত কোথায়! মানুষ যখন তেলের কৃত্রিম সংকটে দিশেহারা, তখন ব্যবসায়ী সংগঠনের কর্তব্য ছিল ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের আগে অকুস্থলে পৌঁছে যাওয়া। মজুত তেল প্রকাশ্যে আনতে বাধ্য করা। তাহলে বোঝা যেত, দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি তাদের কমিটমেন্ট রয়েছে। অথচ ১১ মে’র বৈঠকে দেওয়া তাদের বক্তব্যে মনে হলো, ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের অভিযানে তারা ক্ষুব্ধ। এতে নাকি তাদের সম্মানহানি হচ্ছে। এত কাণ্ডের পর এমন বক্তব্য শুনে মনে হলো, ব্যবসায়ীদের তখনো বোধহয় সম্মান অবশিষ্ট রয়েছে! ব্যক্তিগতভাবে কে বেশি সৎ, কে মাঝারি সৎ, তা দিয়ে কোনো গোষ্ঠীকে বিচার করা যায় না। তাই গোষ্ঠীর সদস্যদের অধঃপতনের দায় সবাইকেই নিতে হয়। অমন লজ্জার দায় থেকে বাঁচতে চাইলে সংগঠিত শক্তিকেই প্রমাণ করতে হয়, তারা জনগণের পক্ষে রয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য জনগণের যে, এ দেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী সংগঠন কেউ জনগণের পক্ষে রয়েছেন এমন প্রমাণ করতে পারছেন না। আসলে গণতন্ত্রের ভিত্তি শক্ত না থাকায় একদিকে যেমন সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যাচ্ছে না, অন্যদিকে কাউকেই জবাবদিহিতার আওতায় আসতে হচ্ছে না।
ইতিহাসের পাঠ নিলে ভবিষ্যতের সংকট আঁচ করা যায়। এগারো-বারো শতকে দক্ষিণ ভারতের ব্রাহ্মণ শাসকরা বাংলার রাজদণ্ড নিয়ে এদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। সাধারণ মানুষ অত্যাচারিত হয়েছিল। শক্তির দাপটে এরা এতটাই মত্ত ছিল যে, সাধারণ মানুষের ক্ষোভকে বিবেচনায় আনার প্রয়োজনই মনে করেননি। ফল হিসাবে তের শতকের সূচনায় বিদেশি তুর্কি রক্তের ধারক মুসলমান অভিযানকারীদের আক্রমণের সময় সাধারণ মানুষ সেন শাসকদের পাশে দাঁড়ায়নি। তাই মুসলিম শক্তির প্রথম আঘাতেই তাসের ঘরের মতো উড়ে যায় সেন শাসনের ভিত্তি।
ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও একশ বছর কম দাপট দেখায়নি। ‘ব্লাডি নেটিভ’ বলে অবজ্ঞা করেছে এদেশের মানুষকে। পরিণতিও একই হলো। বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ডে পরিণত হলেও লোভী বাণিজ্য বুদ্ধির কারণে তা রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খানদের শানিত মস্তিষ্ক না থাকলেও তারা গায়ে-গতরে বাঙালিদের চেয়ে নিজেদের শক্তিমান ভেবেছে। তাই বাঙালিকে শক্তির দাপটে দমিয়ে রাখতে চেয়েছিল। এর বিরূপ ফলাফল হিসাবে ক্ষুব্ধ বাঙালির অগ্নিমূর্তির সামনে দাঁড়াতে হয়। অবধারিত পরিণতি হিসাবে এক সময় নিজেদেরই পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যেতে হয়েছিল। এসবে প্রমাণ হয়, কোনো শক্তিই অসীম নয়।
উনিশ শতকে ইংল্যান্ডের ব্রিটিশ প্রশাসন ঠিকই বুঝেছিল বণিকদের দিয়ে রাজনীতি চলে না। রাজনীতি করবে রাজনীতিকরা। তাই তারা বণিকদের হটিয়ে রানীর শাসনই প্রতিষ্ঠা করেছিল। এ সত্যটি মানতেই হবে যে, সুশাসন প্রতিষ্ঠা না করে অন্যকিছু দিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে মানুষকে আবিষ্ট করে রাখা যায় না। মধ্যযুগে বাংলার বিদেশি সুলতানরা সাধারণ মানুষকে বোঝার চেষ্টা করেছিলেন। প্রকৃত অর্থে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তারা। তাই তারা দীর্ঘ দুই শতাধিক বছর-স্থায়ী বাংলায় স্বাধীন সুলতানি শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। সুলতানদের পতন জনবিক্ষোভে হয়নি। শক্তিমান আরেক বিদেশি মুসলমান শক্তি মোগলদের আক্রমণে পরাভূত হয়েছিলেন সুলতানরা।
ইতিহাস তো মানুষকে এগিয়ে চলার পথ দেখায়। আমাদের ক্ষমতাসীন দলগুলো যদি ইতিহাসের পাঠ থেকে শিক্ষা নিয়ে নীতিনির্ধারণ করতে পারতেন, তবে আখেরে লাভ হতো সবারই।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়