২৩ জানুয়ারি ২০১৮- যুগান্তর
‘আশা করি’ শব্দযুগল ব্যবহার না করে ‘প্রার্থনা করছি’ বলার কারণ আছে। অনেক কিছুই আমরা আশা বা প্রত্যাশা করি, আশাভঙ্গের আশঙ্কাও থাকে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে। প্রচলিত অমানবিক ধারার ভর্তি পরীক্ষাপদ্ধতি নিয়ে কম বলা হয়নি, লেখাও হয়নি। কিন্তু কাজের কাজ হয়নি কিছুই। এখন ভর্তি পরীক্ষা এলে আতঙ্কবোধ করি। নিজেদের অপরাধী মনে হয়। আমরা অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে শিক্ষার্থী আর তাদের অভিভাবকদের নরক যন্ত্রণায় ফেলে দিই। অতীতে এ পরীক্ষাপদ্ধতি নিয়ে বহুবার লিখেছি; কিন্তু এসব লেখালেখিকে কেউ পাত্তা দেয় না। আমি তো ক্ষুদ্র মানুষ- পাত্তা না-ও পেতে পারি। কিন্তু বড় মানুষ অধ্যাপক জাফর ইকবালও কম লেখেননি পরীক্ষাপদ্ধতি নিয়ে। গুচ্ছপরীক্ষার কথা তিনি বহুবার বলেছেন; কিন্তু তা হালে পানি পায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চ্যান্সেলর রাষ্ট্রপতি এবার গুচ্ছপরীক্ষার কথা বলায় একটু নড়েচড়ে বসেছেন অনেকে। ইউজিসিও সরব হয়েছে।
১৫ জানুয়ারি যুগান্তরে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে দেখলাম, দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছভিত্তিক পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে। এ পদ্ধতিতে পরীক্ষা এ বছরই শুরু হয়ে যাবে। এ লক্ষ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ও গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষার রোডম্যাপ তৈরির জন্য উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন একটি কমিটি গঠন করেছে। কমিটিকে বলা হয়েছে ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে রিপোর্ট জমা দিতে।
মনে হচ্ছে এবার বোধহয় সম্ভাবনা কিছুটা এগিয়েছে। আমরা ঘরপোড়া গরুর দশায় আছি, তাই এখনও সিঁদুরে মেঘের ভীতি কাটাতে পারিনি। এ কারণে আশা না করে প্রার্থনাই করছি। কোনো এক দৈব শক্তির কাছে প্রার্থনা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। এই আশঙ্কার বড় কারণ আমাদের প্রচলিত পরীক্ষাপদ্ধতির সমর্থক নিতান্ত কম নন। দলে-বলে শক্তিশালীও। তারা বলতেই পারেন বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। এখানে কখন কী পদ্ধতিতে চলবে তা আমরাই সিদ্ধান্ত নেব। কোনো চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব না। তখনই শুরু হবে জটিলতা। অতীতে এমন সংকট যে তৈরি হয়নি তা তো নয়!
ভর্তি পরীক্ষার সময়টি বড় বেদনার। পরীক্ষার দিন খুব ভোরে হাঁটতে বেরিয়েছি। দেখলাম নাইট কোচ থেকে নামছে একের পর এক পরীক্ষার্থী। হয়তো বাবার সঙ্গে মেয়েটি। হাতে ট্রাভেল ব্যাগ। আলুথালু বসন। চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ। এমন হতে পারে, দিনপাঁচেক আগে ফরিদপুরের বাড়ি থেকে রওনা দিয়েছে। ঢাকায় এসে আত্মীয়ের বাড়ি বা হোটেলে থেকেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা দিয়ে ছুটেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরীক্ষা দিয়েই উঠেছে নাইট কোচে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়তো তিন-চার দিন পরীক্ষা দেবে। কোথায় থাকবে এখনও ঠিক হয়নি। হয়তো ঢাকায় চলে যাবে। সেখান থেকে প্রতিদিন আসা-যাওয়া। এখানে পরীক্ষা দিয়ে আবার নাইট কোচ ধরবে। যাবে চট্টগ্রাম বা শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভর্তির নামে এমন যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা চলছেই। এমন বাস্তবতায় ক’টি ছেলেমেয়ে নিজ ধীরস্থিরভাবে মেধার পরিচয় দিতে পারে?
প্রতি বছর ভর্তি পরীক্ষার সময় পরীক্ষার্থীদের অনেক কষ্টের অভিজ্ঞতা শুনি। বুঝতে পারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ভর্তিযজ্ঞের সঙ্গে আরও কত অক্টোপাস জড়িত। গত বছর ভর্তি পরীক্ষার সময় গ্রামসূত্রে এক মা তার ছেলেকে নিয়ে আমার বিভাগীয় অফিস কক্ষে এলেন। এক সময় কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, আমার ছেলেটি বরাবরই মেধাবী। স্কুল থেকে কলেজ পর্যন্ত ভালো ফলাফল করেছে। গরিবের ঘরে মেধাবী না হওয়াই ভালো। বুঝলাম এটি তার খেদোক্তি। ভর্তি পরীক্ষার জন্য সবাই কোচিং করে। তাই ছেলেকেও কোচিং করাতে হল। অনেক কষ্টে জমানো সাত হাজার টাকা ওখানেই বেরিয়ে গেল। এরপর নানা জেলায় ভর্তি পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। বাড়িতে একটি কড়ই গাছ আর একটি মেহগনি গাছ ছিল। ও দুটো আঠার হাজার টাকায় বিক্রি করে দিতে হল। থাকা-খাওয়া আর গাড়ি ভাড়ায় কুলোচ্ছে না। এখন বাধ্য হয়ে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা আর শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া বাদ দিতে হচ্ছে।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাপদ্ধতিতে আবার রকমফের আছে। কোনো বিশ্ববিদ্যালয় অনুষদভিত্তিক পরীক্ষা নিয়ে দু-তিন দিনে শেষ করে দেয়। আবার কোনো বিশ্ববিদ্যালয় সাত দিন ধরে বিভাগে বিভাগে পরীক্ষা নিয়ে চৌকস বিদ্যার্থী সংগ্রহ করে! এতে বহু কোটি টাকা আয় হয়। এবং তা নানা ঘাটে বিতরণও হয়। ‘তৈরি ছেলের বাবা’ বলে একটি কথা আছে। এসব দেখে মনে হয় আমরা যেন বেছে বেছে মেধাবী তৈরি ছেলে বা মেয়ের বাবা হতে চাই। একটা নির্ধারিত যোগ্যতা নিয়েই তো ছেলেমেয়েরা ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসে। আমি নিশ্চিত এদের সবারই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার যোগ্যতা আছে। একটি ছেলে বা মেয়েকে শিক্ষক গড়ে তুলবেন। বিশ্ববিদ্যালয় তার বিকাশের পথ করে দেবে। তাহলে আমরা সব রেডিমেড চাচ্ছি কেন?
পরীক্ষা জটিল ও শ্রমসাধ্য হওয়ার পেছনে বিপুলসংখ্যক পরীক্ষার্থীর বিষয়টিও বিবেচনায় আনতে হয়। এ উপমহাদেশের শিক্ষানীতির একটি গলদ আছে। এখানে উচ্চশিক্ষার নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াটা অপরিহার্য করে ফেলা হয়েছে। উন্নত বিশ্বে এমনটি হয় না। উচ্চমাধ্যমিক সমতুল্য পড়ার পর যার যার মেধা অনুযায়ী নানা ট্রেড কোর্স শেষে ডিপ্লোমা অর্জন করে। এ সার্টিফিকেটেই প্রতিষ্ঠার পথে হাঁটা যায়। অল্পসংখ্যক শিক্ষার্থী, যারা উচ্চতর গবেষণা করতে চায় তাদের ঝোঁক থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াটা অবারিত করে দেয়ায় শিক্ষার মানে পতন ঘটছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে না এসেই বা উপায় কী! অনার্স-মাস্টার্স ছাড়া চাকরির আবেদন করা যায় না।
অন্যদিকে নীতিনির্ধারণের দুর্বলতায় সরকারি কলেজ ছাড়াও গ্রামগঞ্জে বিভিন্ন বেসরকারি কলেজে নানা বিষয়ে অনার্স খুলে দেয়া হয়েছে। দেখা যাচ্ছে প্রয়োজনীয় শিক্ষক নেই। ক্লাসরুম নেই, তবে ভূরি ভূরি শিক্ষার্থী আছে। সামাল দেয়া যাচ্ছে না- বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এসে ভিড় করছে। ১০০ জনের বিপরীতে হয়তো একটি আসন। লটারি ছাড়া একে আর কী বলা যেতে পারে! অথচ ৯৯ জনই এক শহর থেকে ছুটছে অন্য শহরে মরীচিকার পেছনে। ২০০০ জন ভর্তি করতে পারব জেনেও এক লাখ আবেদন গ্রহণ করে কোটি কোটি টাকা আয় করছি। বিবেকের দংশনও অনুভব করছি না।
অভিভাবক আর শিক্ষার্থীদের নিয়ে এমন মর্মান্তিক খেলার অবসান হওয়া উচিত। আমরা চাই এবার গুচ্ছপদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষার চিন্তাটি বাস্তবে রূপ পাক। এবারের আয়োজনটি দেখে আশাবাদী হওয়ার কারণ তৈরি হয়েছে। জানা গেল, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের রাষ্ট্রপতি বঙ্গভবনে ডেকেছেন। অবশ্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসিদের সিদ্ধান্তই শেষ কথা নয়। এখানে শিক্ষকদের নানা গ্রুপ আছে। আছে শিক্ষক সমিতি। সবার সদিচ্ছার প্রয়োজন পড়বে।
অভিজ্ঞতা আমাদের শঙ্কামুক্ত হতে দিচ্ছে না। অভিন্ন বিষয়গুলো নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গুচ্ছ পরীক্ষা নেয়া যায় কিনা, এ নিয়ে ২০০৭ সাল থেকে কথা চলছে; কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে তেমন সাড়া মেলেনি। গুচ্ছভিত্তিক পরীক্ষা নিয়ে এখনও অস্পষ্টতা রয়েছে। ইউজিসির এক কর্মকর্তা বিষয়টি পরিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন বলে যুগান্তরের রিপোর্টে জানা যায়। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিশেষত্ব অনুযায়ী সেগুলোকে গুচ্ছবন্ধন করা হবে। সে অনুযায়ী সব কৃষিবিষয়ক বিশ্ববিদ্যালয় এক গুচ্ছে আসবে। ঠিক একইভাবে প্রকৌশল ও প্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, সাধারণ- এ ধরনের চরিত্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আলাদাভাবে গুচ্ছবদ্ধ করা হবে।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি ভর্তি মৌসুমে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেয়া, ভর্তি কোচিংসহ আনুষঙ্গিক খাতে একজন ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীর গড়পড়তা খরচ হয় ৯৬ হাজার টাকা। আমি একজন শিক্ষার্থীকে জানি, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ছোটাছুটি করে দেড় লক্ষাধিক টাকা খরচের পর কপালগুণে দিনাজপুরে হাজী দানেশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠাঁই হয়েছে তার।
আমরা রাতারাতি শিক্ষানীতি পরিবর্তন করে উন্নত বিশ্বের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া সীমিত করে ফেলতে পারব না। তবে কতগুলো বাস্তবসম্মত কাজ করতে পারি। যেসব কলেজে যোগ্য শিক্ষক ও আনুষঙ্গিক সুবিধা নেই, সেসব কলেজে অনার্স পড়িয়ে বোঝা না বাড়িয়ে কারিগরি এবং বিভিন্ন ট্রেড কোর্সে পড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি করতে পারি কিনা তা ভেবে দেখা যেতে পারে। সুখ্যাত সরকারি-বেসরকারি কলেজগুলোতে মেধাবী ও দায়িত্বশীল শিক্ষকের সংখ্যা বাড়িয়ে লাইব্রেরি-ল্যাবরেটরির সুযোগ বৃদ্ধি করে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে অনার্স-মাস্টার্স নতুন উদ্যমে চালু করা যেতে পারে। যাতে শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনে না ছুটে সেসব কলেজে ভর্তি হতে উৎসাহিত হয়। এখন যেমন এসব অনেক কলেজে ক্লাস না নেয়া- ক্লাস না করার প্রবণতা আছে, একে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এতে অবশ্য কলেজ পরিচালনার বর্তমান কাঠামোর মধ্যেও পরিবর্তন আনতে হবে। সরকারি কলেজে আমলা নিয়ন্ত্রিত কাঠামোতে নানা উপায়ে বদলির বেড়াজাল থাকায় পাঠদানের ধারা ও নিবিড় পরিচর্যায় ছেদ পড়ে। বড় শহরগুলোর বাইরের কলেজগুলোতে শিক্ষকরা যেতে ও থাকতে যাতে উৎসাহবোধ করেন, এর জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে।
আমরা মনে করি, গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা কার্যকর করা হবে প্রথম সাফল্য। এরপরই পদক্ষেপ নিতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের কলেজগুলোকে বিকল্প হিসেবে তৈরি করা। ভর্তি পরীক্ষাকে মানবীয় পর্যায়ে আনার জন্য এ দুটি বিষয় নিয়েই ভাবতে হবে পাশাপাশি।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়