০১ নভেম্বর ২০২২
বিএনপি তাদের আন্দোলনের অংশ হিসাবে চার জেলায় চারটি সমাবেশ করেছে। জনসমাগমও কম হয়নি। সব সমাবেশের আগেই গণতন্ত্রের দেশে সংশ্লিষ্ট এলাকায় দুদিনের জন্য ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে পরিবহণ মালিক-শ্রমিকরা। ফলে যানবাহন চলেনি। সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষের অবর্ণনীয় কষ্ট হয়েছে। বিএনপি নেতারা দাবি করেছেন, এসব ঘটেছে সরকারের ইঙ্গিতে। যাতে সভায় বেশি লোক সমাগম না হতে পারে। সরকারি দলের নেতা ও মন্ত্রীদের কেউ কেউ এ দাবি অস্বীকার করেছেন। অসহায়ের মতো তারা বলেছেন, বাস মালিকরা যদি তাদের দাবি নিয়ে ধর্মঘট করে যানবাহন বন্ধ করে দেয়, তা হলে সরকারের কী করার আছে! এসব শুনে ও দেখে মনে হচ্ছে, ডিজিটাল বাংলাদেশে আমাদের রাজনীতি এখনো ডিজিটাল হতে পারেনি বলে পুরোনো ফর্মুলায়ই চলছে!
আমরা ভুলে যাই যে, বৈশ্বিক সংকটের কথা বাদ দিলে বর্তমান সরকারের অন্যতম বড় সাফল্য দেশজুড়ে বিদ্যুতায়ন। এখন গ্রামে-গঞ্জে-প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুৎ চলে গেছে। আলোতে অন্ধকারের ভূত বিদূরিত হয়। সাধারণ মানুষ স্বচ্ছভাবে সব দেখতে পায়। গণমানুষকে অন্ধকারে রেখে যা খুশি করা যায় না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল বাংলাদেশ পরিকল্পনা সাধারণ মানুষের দৃষ্টিসীমাকে আরও স্পষ্ট করেছে। তারা দূরগ্রামে বা পাহাড়ে বসেও টেলিভিশন চ্যানেল দেখতে পায়। কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারে। মোবাইল ফোনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও যুক্ত হতে পারছে। তাই এখন আর এদেশের মানুষকে অন্ধকারে থাকা সাধারণ মানুষ বলে ভাবাটা ঠিক হবে না। প্রকৃত সত্য জানা আর এর মূল্যায়ন করার ক্ষমতাও তৈরি হয়েছে। আমাদের নেতারা যদি এখনকার সাধারণ মানুষের মতো ডিজিটাল মেধা নিয়ে নীতিনির্ধারণ করতে পারতেন, তাহলে গতানুগতিক ফর্মুলায় না গিয়ে ভেবে-চিন্তে রাজনৈতিক বক্তব্য দিতেন এবং সেইমতো নীতিনির্ধারণ করতেন। একসময় যা কাজে লাগত এখন যে তা বুমেরাং হতে পারে, সে সত্য গুরুত্বের সঙ্গে ভাবা উচিত।
সাধারণ মানুষের মনে সেই কবিতার লাইন ভাসছে, ‘মাথায় অনেক প্রশ্ন আছে দিচ্ছে না কেউ জবাব তার…’। মানুষ ভাবছে পরিবহণ মালিক-শ্রমিকদের হঠাৎ খণ্ডিত অঞ্চলে ধর্মঘট কেন! নিয়ম তো জানি কোনো দাবিদাওয়া থাকলে অনেক দিন মাঠ সরগরম থাকে। শেষ পর্যন্ত দাবি আদায় না হলে ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়। সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বিবেচনা করে সরকার তৎপর হয়। সরকারি দলের নেতা-মন্ত্রীরা মালিক-শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে নিবৃত করার চেষ্টা করেন। সমাধান না হলে সরকার বিশেষ বিবেচনায় অন্তত সাধারণ মানুষের কষ্ট লাঘবের জন্য সরকারি গাড়ি চালানোর চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে কিছুই ঘটল না। সরকারি দলের নেতা আর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের কেউ কেউ টিভি ক্যামেরার সামনে যেভাবে বক্তব্য রাখলেন একে অসহায় আত্মসমর্পণই বলা যায়! তারা জানালেন পরিবহণ মালিকরা তাদের দাবি আদায়ের জন্য পরিবহণ ধর্মঘট করলে সরকার কী আর করতে পারে।
আমরা পরিবহণ মালিক-শ্রমিকদের কাছে প্রশ্ন রাখতে চাই, আপনারা কেন এভাবে সরকারকে বিব্রত করছেন? সরকারকে দুর্বল-অসহায় করে দিচ্ছেন সাধারণ মানুষের চোখে? আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম-পরিবহণ মালিকদের দাবি আসলে কী ছিল? এক টিভি চ্যানেলের খবরে দেখলাম রাস্তা থেকে নসিমন, করিমন, ভটভটি বন্ধ করার দাবি নাকি ছিল। বিএনপির সম্মেলনের এলাকায় শুধু এ সংকট হলো কেন? শুধু দুদিনের জন্য ধর্মঘটের ডাক কেন? আপনারা কি নিশ্চিত ছিলেন দুদিনে দাবি আদায় হয়ে যাবে? সম্মেলন শেষ হওয়ার পর ধর্মঘট যে উঠিয়ে নিলেন-দাবি কি আদায় হয়েছে? আপনাদের এলাকায় অবৈধ যান চলাচল কি বন্ধ হয়ে গেছে? ঢাকায় আওয়ামী লীগের জেলা সম্মেলন হলো। এ সময়ে ধর্মঘট না ডাকার কারণ আমরা বুঝি। ঢাকায় তো আর নসিমন, করিমনরা ছোটাছুটি করে না। ঢাকার বাইরে আওয়ামী লীগ জনসভা ডাকলে এবং আপনাদের দাবি আদায় না হলে তখন নিশ্চয় আবার আন্দোলন ডাকবেন। আওয়ামী লীগের জেলা সম্মেলনও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এখানেও লোকারণ্য ছিল।
আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়, বিরোধী দলের জনসভার আগে পরিবহণ ধর্মঘট ডাকা দেখে বিএনপি নেতারা এত ক্ষোভ প্রকাশ করছেন কেন? তারা কি পেছনে তাকানোর শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন? নিজেরা যখন ক্ষমতায় তখন আওয়ামী লীগের জনসভা ঠেকাতে একই কাণ্ড করা হয়নি? তাহলে তো দেখা যাচ্ছে, কাটাকাটি করে অঙ্কের ফল শূন্য। পাটা-পুতার ঘষাঘষি একই ‘ছন্দে’ চলছে। শুধু মরিচ নামের সাধারণ মানুষের ত্রাহি অবস্থা। আমরা মেনে নিয়েছি সব পক্ষের রাজনীতির ভেতরে এমন গণতন্ত্রই বিরাজ করছে!
এসব কারণে শুধু শুধু মান্যবর নেতা-নেত্রীরা কষ্ট করে জবানবন্দি দিয়ে সাধারণ মানুষের সামনে আরও খেলো হয়ে যাচ্ছেন। এসব ধর্মঘটের মূল কারণ সবাই জানে ও বোঝে। আমার সাবেক একজন ছাত্র ছাত্রলীগ করেছে সুনামের সঙ্গে। এখন আওয়ামী লীগে সক্রিয়। দুদিন আগে মন খারাপ করে বলছিল, কারা যে এমন পুরোনো ধাঁচের রাজনৈতিক বুদ্ধি দিচ্ছে জানি না। এসব ধর্মঘট ডেকে অর্জন হচ্ছে নাকি পুরোটাই বিসর্জন হচ্ছে বুঝতে পারছি না। সে আমার কাছে প্রশ্ন ছুড়ে দিল। আমি বললাম, অর্জন হওয়ার কোনো কারণ দেখি না। কর্মী-সমর্থকরা জানে কীভাবে এসব বাধা সরিয়ে জনসভায় আসতে হয়। অনেকেই এসেছে এবং সভাস্থল লোকারণ্য হয়েছে। পরিবহণ স্বাভাবিক থাকলে সামান্য কিছুই না হয় যোগ হতো। বিসর্জন এটাই হয়েছে, এ সমাগম দেখে অনেকেই মনে করতে পারে পরিবহণ স্বাভাবিক থাকলে আরও লাখ লাখ মানুষ যুক্ত হতে পারত। গোপনীয়তার ক্ষতি এখানেই। আওয়ামী লীগ বিনা বাধায় তাদের জনসভায় বিপুল জনসমাবেশ ঘটাবে, তখনো মানুষ ভাববে বিএনপির জনসভায় বাধা না দিলে আরও বেশি জনসমাগম হতো। আমরা মনে করি, এজন্য বিএনপি নেতাদের আওয়ামী লীগের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।
বিএনপি ক্ষমতায় তো অনেক দিন ছিল। নির্মোহ মানুষ কি বলবে তেমন উল্লেখ করার মতো দেশোন্নয়নে তারা ভূমিকা রেখেছেন? ওই আমলে চুরি-দুর্নীতি তো কম হয়নি! সন্ত্রাসের চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা তারা দেখিয়েছে। ভয়ানক সন্ত্রাসী কার্যক্রমে তাদের সংশ্লিষ্টতা মানুষকে নতুন করে জানাতে হবে না। নির্বাচনের মাঠে এসব বিএনপির গায়ে বড় বড় ক্ষত হয়ে দেখা দিচ্ছে। এ প্রেক্ষাপট আড়াল করে বিএনপি নেতাদের এমন দিবাস্বপ্ন দেখা ঠিক হবে না যে, তারা আন্দোলন করে সরকার ফেলে দেবেন বা নির্বাচনে না গিয়ে শূন্যতা সৃষ্টি করবেন। তারা নিকট অতীতে ক্ষমতায় আসার জন্য জনগণের কাছে না গিয়ে অরাজকতা সৃষ্টি করেছিল গোলেমেলে অবস্থার মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসার লক্ষ্যে অথবা বিদেশি শক্তির সহায়তায় মোক্ষলাভ করতে। পাকিস্তান টাইপের দেশ ছাড়া সে সুবিধা বিএনপিকে কে দেবে! আন্তর্জাতিক অনেক শক্তি দুর্বল দেশের সরকার পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে। কিন্তু তার আগে বিবেচনা করবে সেই দলের জনপ্রিয়তা কতটুকু আছে। দেশ পরিচালনায় পূর্বাপর দক্ষতা কতটা দেখাতে পেরেছে। তারা সমর্থন দিলে কতটা লভ্যাংশ ঘরে তুলতে পারবে। এজন্য মাঠের রাজনীতির পাশাপাশি সাধারণ মানুষের কাছে যাওয়া জরুরি; যা বিএনপি করছে বলে আমাদের মনে হচ্ছে না। আঠারো কোটি মানুষের দেশে পাঁচটি জনসভায় দশ লাখ মানুষের জমায়েত ঘটিয়ে জনপ্রিয়তা দেখানো যায় না।
বিএনপির তুলনায় সরকার পরিচালনায় আওয়ামী লীগের অর্জন তো কম নয়। শুধু মেঠো বক্তৃতা নয়, কার্যত এ সরকার নিজ গায়ে শত ক্ষত তৈরি করলেও দৃশ্যমান করতে পেরেছে দেশোন্নয়ন, অবকাঠামোগত বিস্ময়কর সাফল্য দেখাতে পেরেছে। জনজীবনে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। বর্তমান বৈশ্বিক সংকট ও রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক দুর্নীতির কারণে মানুষের কষ্ট বাড়লেও স্বাভাবিক সময়ে সর্বশ্রেণির মানুষের জীবনমানের অনেক উন্নতি দৃশ্যমান ছিল। এ ডিজিটাল যুগে সাধারণ মানুষ এসবে মূল্যায়ন করবে না, তা বোধহয় ঠিক নয়। এ সময়ের আওয়ামী লীগ নেতাদের যত চাঙা মনবল থাকা উচিত ছিল, আমরা কিন্তু ততটা দেখতে পারছি না। এর বড় কারণ বোধহয় সরকারের সুশাসনের পথে হাঁটতে না পারা। দলীয় সন্ত্রাস-দুর্নীতি থেকে বেরোতে পারছে না বলে। উৎকট দলীয়করণও আওয়ামী লীগকে বলয়বন্দি করে ফেলছে। বন্ধু বাড়াতে পারছে না। তাই বিএনপির আন্দোলনের মুখে কিছু অপ্রতিভ দশা দেখা যাচ্ছে নেতা-মন্ত্রীদের ভাষ্যে ও দৈহিক ভাষায়। বিএনপির জনসভার আগে পরিবহণ ধর্মঘট সমস্যার সমাধানে সরকারি দলের জোরালো তৎপরতা না দেখানো কোনোভাবেই আওয়ামী লীগের পক্ষে যাবে না বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করে। আজ আমরা মনে করি, আত্মশক্তি বাড়িয়ে জনগণের কাছেই যেতে হবে আওয়ামী লীগকে। মঞ্চের গণতন্ত্র ছেড়ে প্রকৃত গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন।
এগারো শতকের মাঝামাঝি দক্ষিণ ভারত থেকে বাংলার পাল রাজাদের সেনাবাহিনীতে চাকরি করতে এসেছিল ব্রাহ্মণ সেন রাজারা। একসময় পাল রাজাদের হটিয়ে অবৈধভাবে বাংলার শাসনক্ষমতা কেড়ে নেয়। কিন্তু বৈধতা না থাকায় মানসিকভাবে দুর্বল করে দিয়েছিল সেন রাজাদের। সাধারণ মানুষ যাতে প্রতিবাদ না করতে পারে, তাই নানা অনুশাসন দিয়ে পীড়িত করতে থাকে তাদের। এর ফল ভালো হয়নি। বহিরাগত মুসলমান শক্তি আঘাত হানলে পীড়িত সাধারণ মানুষ স্বধর্মীয় শাসকদের পাশে দাঁড়ায়নি। পতন ঘটেছিল সেন বংশের। অন্যদিকে বহিরাগত মুসলমান সুলতান ও মোগলরা ছয় শতাধিক বছর বাংলা ও ভারত শাসন করেছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তারা। নিজেদের তারা এদেশের কল্যাণেই নিয়োজিত করেছিলেন। তাই জনশক্তি এ বিদেশি শাসকদের বিরুদ্ধে যায়নি।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়