২৮ জানুয়ারি ২০২০
আজ থেকে তিন দশক আগেও উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে র্যাগিং নামের নেতিবাচক শব্দটির সঙ্গে অধিকাংশের পরিচয় ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচিত ছিল র্যাগ-ডে নামের শব্দটি। স্নাতকোত্তর পড়া শেষে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার আগে ছাত্রছাত্রীরা একটি বিদায়ী আনন্দ-উৎসবের আয়োজন করত।
র্যাগ-ডে নামের এ উৎসব ছিল নিটোল আনন্দের। সারা দিন উৎসব শেষে সন্ধ্যায় বিদায়ী শিক্ষার্থীদের সৌজন্যে উপাচার্যের পক্ষ থেকে একটি ডিনারের আয়োজন করা হতো। ডিনারের শুরুতে উপাচার্য মহোদয় পাণ্ডিত্যপূর্ণ বক্তৃতা দিতেন। জীবনে চলার পথের যেন কিছু মূল্যবান পাথেয় দিতেন তিনি।
আমার মনে পড়ে, আমাদের সময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী স্যার। মনে পড়ে, আমরা আমাদের শিক্ষাজীবনের এ শেষ উৎসবকে র্যাগ-ডের বদলে নাম দিয়েছিলাম সমাপনী উৎসব। ডিনার অনুষ্ঠানে সিদ্দিকী স্যারের উদ্দীপনাপূর্ণ বক্তব্য এখনও কানে বাজে।
আজকাল র্যাগ-ডে নানা নামে পালিত হয়। আনুষ্ঠানিকতার আতিশয্য থাকলেও শিক্ষার্থীদের অনেকের একাডেমিক গাম্ভীর্য অনেকটা যেন কমে গেছে। এখন র্যাগ-ডের রাজা-রানী নির্বাচন নিয়ে নানা টানাপোড়েন তৈরি হয়। তা অনেক সময় মাত্রাও ছাড়িয়ে যায়।
আমাদের সময় র্যাগ-ডেকে কেন্দ্র করে বিদায়ী শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ প্রতিভা দিয়ে সাংস্কৃতিক উৎসব মাতিয়ে তুলতেন। আর এখন সব ভাড়ায় চলে। কে কত লাখ টাকা দিয়ে ব্যান্ডের দল এনে কনসার্টের আয়োজন করেছে, এর এক অলিখিত প্রতিযোগিতা হয়।
বেশ কয়েক বছর আগে একজন বিদায়ী ছাত্র দুঃখ করে বলেছিল, স্যার, আমি বন্ধুদের কাছে প্রস্তাব রেখেছিলাম সমাপনী উৎসবের জন্য বেশ বড় অঙ্কের যে চাঁদা উঠেছে, তা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ‘পুওর ফান্ড’ তৈরি করতে পারি কি না। এতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদের কিছুটা অবদান থাকবে। কিন্তু পত্রপাঠ আমাকে উড়িয়ে দিল বন্ধুরা।
তারপরও র্যাগ-ডে বা সমাপনী উৎসব নিয়ে তেমন বড় কোনো সংকট নেই। সংকট তৈরি হয়েছে র্যাগিং নিয়ে। গত শতকের নব্বইয়ের দশকের আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং বিষয়টি অনেকটা অপরিচিত ছিল। র্যাগিংয়ের আভিধানিক অর্থ ‘রসিকতার নামে অত্যাচার করা’।
১৯৯২ সালে আমি কলকাতায় থাকাকালীন র্যাগিং বিষয়টি সম্পর্কে প্রথম অবহিত হই। ওখানকার পত্র-পত্রিকায় হইচই হচ্ছিল। আমার এক ভাই খড়গপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে তার ছেলেকে ভর্তি করিয়েছিলেন। র্যাগিংয়ের ছোবলে অনেকটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ছেলেটিকে পড়াশোনা বাদ দিয়ে দেশে ফিরতে হয়েছিল।
সিনিয়র ছাত্ররা নবাগতদের গড়ে তুলতে নাকি নানারকম শাস্তি দিত। ক্রমে তা ভয়ংকর মাত্রা ছাড়িয়ে যেত। কে যে ওদের হাতে এমন শাসন করার দায়িত্ব দিয়েছে, কে জানে! কলকাতার কাগজে শুধুই এসব র্যাগিং তাণ্ডবের ভয়ংকর নিউজ প্রকাশিত হতো।
র্যাগিংয়ের অত্যাচার সহ্য না করতে পারায় একাধিক আত্মহত্যারও খবর বেরোয়। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। ভারতীয় আদালত র্যাগিং বন্ধের পক্ষে রায় প্রদান করে।
সব মন্দ জিনিস দ্রুত আত্মস্থ করতে যেন আমরা পছন্দ করি। ভারতে আইনত পরিত্যাজ্য র্যাগিং মহামারীর মতো দ্রুত আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলে আসে। র্যাগিংয়ের মতো একটি অমানবিক আচরণ এখন রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়ে আরও লাগামহীন হয়ে পড়ছে।
এ ভয়াবহ বাস্তবতায় এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনকে প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থীদের ভর্তির সময় থেকে র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে হয়। এরপরও র্যাগিং বন্ধ করা যাচ্ছে না।
একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ভবিষ্যতে দেশের প্রথম শ্রেণির নাগরিক হয়ে বের হবে। দেশ পরিচালনায় অংশ নেবে। তারাই যদি বিবেকহীন অমানবিক আচরণ করে তাহলে এদের কাছ থেকে দেশ কী পাবে!
বিবেকের পরাজয় ও রুচি কতটা নিুগামী হয়ে পড়েছে যে, অনেক স্বপ্ন নিয়ে শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দিয়েই একটি বৈরী পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। যেখানে সিনিয়র ভাইবোনের আশ্রয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ওদের পথ চলা দৃঢ় হবে, সেখানে ওদের নিপীড়িত হতে হচ্ছে।
র্যাগিংয়ের যেসব নমুনার কথা শুনি, তা ভয়ংকর ও অমানবিক। যেমন- ১. তুমি সিনিয়রকে দেখে সালাম দাওনি কেন; এর জন্য একশবার কান ধরে ওঠবস কর, ২. শীতের রাতে খালি গায়ে এক ঘণ্টা ছাদে দাঁড়িয়ে থাক, ৩. পানাপুকুরে ডুব দিয়ে আস। তাছাড়া চড়-থাপ্পড় তো আছেই।
একবার ছাত্রীহলে এক সিনিয়র ছাত্রীর নামে অভিযোগ শোনা গেল, সে নাকি র্যাগিংয়ের নেতৃত্ব দেয়। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকল্যাণ কেন্দ্রের পরিচালক। একদিন মেয়েটিকে ডেকে আনলাম। দেখলাম, এ কাজে ওর বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই। ও বলতে চাইল, সিনিয়র হিসেবে এটা ওর দায়িত্ব।
র্যাগিংয়ের মাধ্যমে ওরা নবীন শিক্ষার্থীকে বলিষ্ঠ করে তুলছে। ওদের স্মার্ট বানাচ্ছে। আমি বললাম, একজন প্রকৃত স্মার্ট মানুষের আচরণ তো তোমার মধ্যে নেই। তুমি নিজে স্মার্ট না হয়ে আরেকজনকে স্মার্ট বানাচ্ছ কেমন করে? এমন আচরণের জন্য ভবিষ্যতে তুমি নিজেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না।
আমি ওকে ইতিহাসের গল্প শোনালাম। বললাম, পোশাকে-কথায় তোমরা নিজেদের খুব স্মার্ট ও আধুনিক মনে করছ। ধর, তোমরা এমন তিনজন স্বনির্বাচিত আধুনিক ছেলেমেয়ে পথের পাশের চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে চা হাতে গল্পে মশগুল। এ সময়ে একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন।
গায়ে সস্তা ফতুয়া, পরনে মলিন ধুতি, পায়ে আধাছেঁড়া চটি, হাতে কিছু বইপত্র। তারও চায়ের তেষ্টা পেয়েছে। বেঞ্চির একটু ফাঁকা জায়গায় তিনি বসলেন। তোমাদের মতো আধুনিক তরুণ-তরুণীর কাছে এ এক উপদ্রব মনে হল। তোমরা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললে, ‘আঙ্কেল, আপনি ওইদিকের বেঞ্চিতে গিয়ে বসুন।’
তোমরা চিনতেই পারলে না, তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। উনিশ শতকে ইউরোপীয়রা দু’জন মাত্র আধুনিক ভারতীয়র কথা বলেছিলেন- একজন রাজা রামমোহন রায় আর অন্যজন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তারা পোশাকে নন, কর্মের মধ্য দিয়ে যুগ অতিক্রম করেছিলেন।
সে যুগে বসে তারা অনেক মানবিক ও আধুনিকমনস্ক হতে পেরেছিলেন। আমাকে একজন মনোবিজ্ঞানী বলেছিলেন, যারা এ ধরনের র্যাগিংয়ে যুক্ত থাকে; দেখবেন, তাদের পারিবারিক ঐতিহ্য তেমন সুগঠিত নয়। অথবা এরা যে প্রেক্ষাপট থেকেই আসুক বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বখে গেছে।
আমি ভাবি, এই যে কিছু বখাটে তরুণ-তরুণী র্যাগিংয়ের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে সবে পা দেয়া সতীর্থদের মধ্যে ভীতি ও ঘৃণা ছড়াচ্ছে, এর পরিণতি কী হচ্ছে? অনেকে এসব দুর্ব্যবহারে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
অনেকে একটি ঘৃণা ও অশ্রদ্ধা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো পার করছে। কারও কারও মধ্যে প্রতিশোধস্পৃহা জন্ম নিচ্ছে। অপেক্ষা করছে সিনিয়র হওয়ার; ঝাঁপিয়ে পড়বে জুনিয়রদের ওপর।
পাশাপাশি আমি নিজের অতীতের দিকে তাকাই। প্রায় চল্লিশ বছর আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে এসেছিলাম। মনে পড়ে, ফরম পূরণ করে জমা দিতে গিয়ে বিপাকে পড়েছিলাম। একদিন পর প্রবেশপত্র নিতে বলল। আমি নারায়ণগঞ্জ থেকে এসেছি।
আবার অত দূর থেকে পরদিন আসা কঠিন হবে। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা অত ভালো ছিল না। এ সময় কাছাকাছি দাঁড়িয়েছিলেন একজন সিনিয়র ছাত্র। তিনি আমার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিলেন। ভূগোল বিভাগের শেষবর্ষের ছাত্র। কাশেম ভাই তার হল চিনিয়ে দিলেন।
বললেন, পরীক্ষার দিন আগে আগে চলে আসতে। তিনি প্রবেশপত্র তুলে রাখবেন। আমার মনটা ভরে গেল। পরীক্ষার দিন এক ঘণ্টা আগে চলে এলাম। ভাই আমাকে চা-নাশতা খাওয়ালেন। সযত্নে রাখা প্রবেশপত্রটি হতে তুলে দিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে একটি ইতিবাচক ধারণা তৈরি হয়ে গেল সেদিনই।
ভর্তি হওয়ার পর আলবেরুনী হলের তিন তলায় সিট পেলাম। বেডিংপত্র নিয়ে হাজির হলাম হলে। আমার রুমমেট সবে এমএ পরীক্ষা শেষ করেছেন। আরও কিছুদিন থাকবেন হলে। আমার গোছগাছে সাহায্য করলেন। তিনি হয়তো ভাবলেন, এ সিনিয়র ভাইটির সঙ্গে থাকতে আমি অস্বস্তি বোধ করব।
বিকালে এসে বললেন, চারতলায় এক বন্ধুর সঙ্গে তিনি থাকবেন। আমি যাতে নিশ্চিন্তে এ ঘরে থাকি। সন্ধ্যায় পাশের রুমের ফিজিক্সের এক বড় ভাই পরিচিত হতে এলেন। পরম আদরে আমাকে নিয়ে গেলেন নিচে। দেখিয়ে দিলেন, কোথায় খাবারের কুপন কিনতে হয়। ডাইনিং হল কোথায়। টিভি রুম কোথায়।
আরেক বড় ভাই এলেন পরদিন দুপুরের পর। আমাকে নিয়ে গেলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে। লাইব্রেরি কার্ড করার নিয়ম শিখিয়ে দিলেন। কীভাবে বই তুলতে হয়, রিডিং রুমে পড়ার নিয়ম কী- সব হাতে-কলমে শিখিয়ে দিলেন তিনি।
আমরা ছাত্রজীবনের শুরু থেকে এভাবে সিনিয়রদের স্নেহ পেয়ে ধন্য হয়েছি। আমরাও সিনিয়র হয়ে একই আচরণ করেছি জুনিয়রদের প্রতি। এ সুখস্মৃতি এখনও মুগ্ধতা ছড়ায়। এসব বড় ভাইকেই আমার প্রকৃত স্মার্ট ও আধুনিক মনে হতো।
হল প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত একজন শিক্ষক বলছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়কে র্যাগিংমুক্ত করা যাচ্ছে না প্রধানত ক্ষমতাসীন ছাত্র নেতৃত্বের কারণে। এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে, হলের নিয়ন্ত্রণ এখন অনেকটাই প্রশাসনের চেয়ে ছাত্র নেতৃত্বের হাতে থাকে।
নবীন ছাত্রছাত্রীদের নিজেদের দলে ভেড়াতে নাকি র্যাগিংয়ের মতো নিবর্তনমূলক আচরণ করতে হয়। ক্ষমতাধরদের প্রতি নতজানু না থাকলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভোগ করতে হয় নির্যাতন। নিবর্তনের ক্যাম্প হিসেবে গেস্টরুম কালচারের কথা তো সবাই জানেন।
হল প্রশাসনে যুক্ত শিক্ষকদের পেছনে প্রচুর অর্থ ও অবকাঠামোগত খরচ থাকলেও তারা গেস্টরুমের নির্যাতন সেল বন্ধ করতে পারেন না। নতজানু নীতির কারণে ছাত্রনেতাদের মাথায় হাত না বুলালে নাকি টেকা দায়। আমি দীর্ঘদিন হলে প্রাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছি।
তখন হয়তো পরিস্থিতি অতটা নাজুক ছিল না। হলের নিয়ন্ত্রণ তখন আমাদের হাতেই ছিল। এখন অবস্থা পাল্টে গেছে। রিমোট কন্ট্রোল এখন ক্যাম্পাসের বাইরে, নেতাদের হাতে।
ফলে ছাত্রনেতা-কর্মীদের রামরাজত্ব বন্ধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এদের ছত্রছায়া ও পরিকল্পনা যদি র্যাগিংয়ের মতো অপসংস্কৃতির ইন্ধন দিতে কাজ করে, তবে ক্যাম্পাস কলঙ্কমুক্ত হবে কেমন করে!
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়